৭১ এ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় অধ্যায়ের সাথে মিশে আছে ভিনদেশী কিছু বন্ধুর নাম। মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি আমাদের বিদেশী বন্ধুরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
এদের অনেকের সম্পর্কে আমরা জানি , যাদের অনেককেই পরবর্তীতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় ভাবে সন্মানিত বা সংবর্ধিত করেছে ।
কিন্তু এই মানুষ টাকে কি আমরা জানি ? যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এদেশের মানুষের দুঃখ দুর্দশার কথা শুনে এদেশের মানুষের সাহায্যার্থে আজকের এই দিনে আস্ত একটি প্লেন হাইজ্যাক করে বসেছিলেন ।
জঁ ইউজিন পল ক্যুয়ে। চিন্তা-চেতনায় বিচিত্রমুখী ফরাসি এই লেখক জীবনে নানাবিধ অভিজ্ঞতা অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন তাঁর অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়তার কারণে । প্রথম দিকে তিনি ছিলেন ফরাসি সেনাবাহিনীর সদস্য, একসময় সেনাবাহিনী ছেড়ে দিয়ে যোগ দেন কুখ্যাত ও এ এস এ নামক গোপন বাহিনীতে যারা আলজেরিয়াকে মনে করত ফ্রান্সের অবিচ্ছেদ্য অংশ । আঁদ্রে মালরোর রচনা পড়ে বোধোদয় হয় পল ক্যুয়ে’র । তবে পুরোনো মতাদর্শের জের একেবারে কাটিয়ে উঠতে না পেরে স্পেন, লিবিয়া ও বায়াফ্রার বিভিন্ন দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীর সঙ্গে ভিড়ে যান ।
একাত্তর সালে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলির খবর তাঁকে আলোড়িত করেছিল । আঁদ্রে মালরোর বাংলাদেশের পক্ষে লড়বার সংকল্প বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে পল ক্যুয়েকে । ৩রা ডিসেম্বর ১৯৭১ তিনি এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটিয়ে বসলেন, প্যারিসের অরলি বিমানবন্দরে এসে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের একটি বোয়িংয়ের নিয়ন্ত্রণ নেন পল ক্যুয়ে। তিনি সবাইকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে তার ব্যাগে বোমা আছে। তাঁর ব্যাগ থেকে বের হয়ে আসা বৈদ্যুতিক তার জানান দিয়েছিল ভেতরে বহন করা বোমার ব্যাপার। এরপর তিনি এক অদ্ভুত দাবী জানিয়ে বসলেন- না, টাকা-পয়সা কিছু না, জাহাজে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার জন্য লড়তে থাকা মুক্তিকামী মানুষের জন্য অবিলম্বে ২০ টন মেডিকেল সামগ্রী ও রিলিফ প্লেনটিতে তোলা না হলে এটি বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। ক্যুয়ের দাবী অনুযায়ী বিমানে রিলিফ সামগ্রী তোলা হয়। রেডক্রস ও বিমানবন্দর কর্মীদের ছদ্মবেশে পুলিশ অবশেষে তাকে গ্রেফতার করে। ব্যাগ খুলে দেখা যায় সেখানে রয়েছে কতগুলো বই, এক কপি বাইবেল এবং একটি ইলেকট্রিক শেভার। শেষ হয় প্রায় পাঁচ ঘন্টার এই ছিনতাই অধ্যায়। ওষুধ এবং রিলিফ সামগ্রী অবশ্য পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় ফ্রান্স এবং সেটার দায়িত্ব দেওয়া হয় অদ্রে দা মাল্তে নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে।
তার পরপরই উপমহাদেশে শুরু হয়ে যায় সর্বাত্মক যুদ্ধ। সেই ডামাডোলে হারিয়ে যায় পল ক্যুয়ে-র এই লোমহর্ষক ঘটনা। তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা চলেছিল বেশ কিছুকাল। আদালতে তাঁর পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন আঁদ্রে মালরো স্বয়ং। অবশ্য অভিযোগ থেকে খালাস পেয়ে যায় পল ক্যুয়ে, এবং তারপর আবার বেরিয়ে পড়েছেন অ্যাডভেঞ্চারের সন্ধানে।
( তথ্য সংগ্রহ ; নিভৃত স্বপ্নচারী )
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৫:৩৪