নৈঃস্বর্গের মৃত্যু উপত্যকা ....
( ডিজিটাল ভ্রমন..... ছবি আর লেখায় / প্রথম পর্ব )
ডানহাতখানা কপালে রেখে সূর্য্যের ঝলসানো আলো ঠেকিয়ে দিগন্তে তাকালো স্মীথ । চোখ কুঁচকে আছে তার । দিগন্তপ্রসারী ঢেউ খেলানো ধূ-ধূ বালিয়ারী থেকে উঠে আসছে আগুনের হলকা । দরদর করে নেমে আসা ঘামে তার কালো চামড়া চকচক করে উঠছে । নিচের উপত্যকা আর দুরের অস্পষ্ট পাহাড়শ্রেনী তীব্র হিটওয়েভ এর কারনে যেন কাপছে থিরথির করে । ঐ পাহাড় ছাড়িয়ে আর কতোপথ পাড়ি দিতে হবে তাকে ! স্বপ্নের সোনা কি জুটবে তার ভাগ্যে ?
ছবি -১ ..... লক্ষ লক্ষ একর জুড়ে পড়ে থাকা উষর বৃক্ষবিহীন বালিয়ারী.....
ক্যালিফোর্নিয়ার পূব অঞ্চলের এই নরকের মতো গনগনে মোজাভ ডেজার্টের সল্টলেক সিটির সীমানায় দাঁড়িয়ে আছে সে । বুঝতে চাইছে যেন সামনের লক্ষ লক্ষ একর জুড়ে পড়ে থাকা উষর বৃক্ষবিহীন বালিয়ারী , কঠিন পাহাড়শ্রেনীর হালচাল । মোজাভ মরুভূমির এই বৈরী উপত্যকার শত শত মাইল পেড়িয়ে তাকে পৌঁছুতে হবে সিয়েরা নেভাদার পাহাড়ী ঢালে । তারপরে আর কতো মাইল পেরুতে হবে তাকে, “সাটার’স মিল” এলাকায় যেতে ? যেখানে ভাগ্য ফেরাতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে সারা আমেরিকার মানুষ ? পথের ধুলোয় যেখানে মিশে আছে সোনা আর সোনা ?
সোনার খোঁজে শুধু সে –ই নয়, ক্যাপ্টেন জেফারসন হান্টের নেতৃত্বে সল্টলেক সিটিতে জড়ো হয়েছে আরো আরো ভাগ্যান্বেষী । যদি কপাল ফিরে যায় ।
ছবি -২ ..... ভাগ্য ফেরাতে হুমড়ি খেয়ে পড়া মানুষ । ক্যালিফোর্নিয়া গোল্ড রাশ ।
১৮৪৯ সালের অক্টোবরের এক মধ্য সকালে তারই মতো কালো চামড়ার জো আর লিটল ওয়েষ্ট এর থেকে দশগজ দুরে দাঁড়িয়ে মনটাকে শক্ত করলো সে ।
সোনা হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে, ডাকছে লিটল ওয়েষ্ট আর জো কেও । তাদের পেড়িয়ে যেতেই হবে এ পথ । ৪৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা তার গায়ে আগুনের ছ্যাকা দিয়ে যাচ্ছে যেন । গরু আর খচ্চরে টানা ওয়াগনের কাছে জড়ো হওয়া দলটির দিকে তাকালো স্মীথ।
এই মহা নরকের পথ কখন, কতোদিনে , কিভাবে পেড়িয়ে যেতে হবে তার পরিকল্পনা চলছে ওখানে । তুষার ঝড়ে কয়েক বছর আগে এই পথেই সোনার খোঁজে যাওয়া ডোনার পার্টির মর্মান্তিক পরিনতির কথা এখনও জেগে আছে দলটির মনে । তাই জানে, শীত নামার আগেই এই নরক উপত্যকার পথ ধরে সিয়েরা নেভাদার ঢাল পেড়িয়ে যেতে হবে ওদের । যেন কিছুতেই তুষার ঝড়ের সামনে পড়তে না হয় । ওল্ড স্প্যানিস ট্রেইল ধরে গেলেই তাড়াতাড়ি হবে । শীতের বরফে সল্টলেক সিটিতেই আটকে থাকার কোনও মানে নেই । ট্রেইলটি সিয়েরা নেভাদার দক্ষিন পাশ ঘেসে গেছে আর শীতকালেও ট্রেইলটি নিরাপদ । কিন্তু সমস্যা হলো, ট্রেইলটি চেনে এমন কোনও ওয়াগন চালক নেই দলে ।
তবুও চলা শুরু হলো ভাগ্যকে সামনে রেখে । সল্টলেক সিটিতে খামোখা বসে থাকার কোনও যুক্তি নেই । ইতিমধ্যেই অনেক দেরী করে ফেলেছে দলটি । আরও দেরী হলে সোনার ভাগ না ও পাওয়া যেতে পারে । উৎসাহে টগবগ করছে দলের লোকেরা । এর মধ্যেই কে এক নবাগত আগন্তুক এক শর্টকাট পথের খবর নিয়ে এলো । “ওয়াকার পাস” এর পথ ধরে গেলে দলটি ৫০০ মাইলের মতো এই নরকসম মরুভূমির রাস্তা কমিয়ে ফেলতে পারবে । পথটি মনঃপূত হলোনা ক্যাপ্টেন জেফারসন হান্টের ।
কিন্তু সোনা বলে কথা । ক্যাপ্টেন হান্টকে ফেলে দল থেকে একশ’র ও বেশী ওয়াগন ধরলো “ওয়াকার পাস” এর পথ । জো , লিটল ওয়েষ্ট আর স্মীথ রইলো ওয়াগন বহরের পুরোভাগে । কিন্তু বিধি বাম ! যাত্রার দুদিনের মাথায় গভীর এক গিরিখাতের প্রান্তে এসে থমকে দাঁড়াতে হলো দলটিকে । এ গিরিখাত পেরিয়ে যাবে কে ? দলের অধিকাংশ ওয়াগন মুখ ঘুরিয়ে ফিরে চললো ক্যাপ্টেন হান্টের পথ ধরতে । দুঃসাহসে ভর করে থেকে গেল স্মীথ আর বন্ধুরা বাকী ২০টি ওয়াগনের সাথে । ভাগ্যদেবী যদি সহায় হন তবে তাড়াতাড়িই তারা পৌঁছে যেতে পারবে গন্তব্যে । ওয়াগনের মুখ ঘুরিয়ে গভীর ক্যানিয়নটিকে ঘুরে পাশ কাটাতে অজানা এক পথ ধরে চললো স্মীথ এর কাফেলা । খরচ হয়ে যেতে থাকলো এক একটি মূল্যবান দিন । আগুনের হলকা গায়ে মেখে তবুও শেষ বাঁকটি পেড়িয়ে গেলো দলটি ক্যানিয়নের গভীর খাত ছাড়িয়ে । সামনে বৃক্ষের ছায়া বিহীন মাইলের পর মাইল ছড়িয়ে থাকা বালি আর লবনে মাখানো রুক্ষ ধূঁ-ধূঁ মরুভুমি –গ্রুম লেক উপত্যকা ।
ছবি -৩ - গ্রুম লেক .. লবনে মাখানো রুক্ষ ধূঁ-ধূঁ মরুভুমি ।
স্মীথ এর মন কু গেয়ে উঠলো এতোক্ষনে । ভাগ্যদেবী মুখ তুলে চাইবেন তো ? কিন্তু কোন পথে যেতে হবে , কোন দিকে ! পথের খোঁজে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে গেল দলটি । দক্ষিনে বহুদুরের বরফাচ্ছাদিত মাউন্ট চার্লসষ্টোন হাতছানি দিয়ে ডাকছে যেন ভাগ হয়ে যাওয়া একটি দলকে । দুষ্প্রাপ্য পানির দেখা মিলতে পারে ওখানে । দক্ষিনের পথেই ওয়াগনের মুখ ঘুরলো তাদের । এই নরককুন্ড থেকে বেরিয়ে সম্ভাব্য একটি আশ্রয় লাভের আশায় শ্রান্ত দলটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো যেন ।
স্মীথ এর ভাগ্য বিধাতা তখন আর এক হিসাবে ব্যস্ত । আর সোজা পশ্চিমমুখো গেলেই পাওয়া যেতে পারে ওয়াকার পাস, এই আশায় জে-হকার’স নামের মূল দলটি সোজা পশ্চিমের পথ ধরলো । ওয়াকার পাস এর খোঁজে । জো , লিটল ওয়েষ্ট আর স্মীথ রইলো দলটির আগেভাগে ।
সল্টলেক সিটি থেকে বেড়িয়েছে তারা দু’মাস হয়ে গেল প্রায় । খাবারে টান ধরলো । পানির পাত্র তলানীতে এসে ঠেকতে চাইলো । তবুও যেতে হবে, ফেরার পথ ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে যে । অথচ এখনও সিয়েরা নেভাদার দেখা নেই ।
ছবি - ৪ ---- The Lost '49ers
স্মীথ এর ভাগ্যে সিয়েরা নেভাদার দেখা আর মেলেনি কোনদিন । সিয়েরা নেভাদার পথে প্যানামিন্ট ভ্যালী ছাড়িয়ে রোদ ঝলসানো তপ্ত অজানা আর এক উপত্যকায় রেড ইন্ডিয়ানদের হাতে মৃত্যু ঘটে তার । আর সে থেকেই উপত্যকাটির নাম হয়ে যায় – মৃত্যু উপত্যকা । ডেথ-ভ্যালী ।
ডেথ-ভ্যালীর গল্প এখানেই শেষ নয় ।
সোনা খোঁজার দল “দ্য লষ্ট ফোর্টিনাইনার্স ” (Lost '49ers) যে ভাবে দুটো দলে ভাগ হয়ে গিয়েছিলো সিয়েরা নেভাদার পথে , আপনারাও যদি তাদের সাথে পথ চলতে থাকেন তবে জানবেন ; গল্পটিও সেভাবে দু’ভাগ হয়ে গেছে এখান থেকে । কালো চামড়ার স্মীথ, জো আর লিটল ওয়েষ্টের গল্প নেই ডেথ-ভ্যালীর কোনও গুজব – গল্পে । ভাগ্যান্বেষী এই তিন কালো চামড়ার মানুষের রং, ঘামের গন্ধ হারিয়ে গেছে নেভাদার পথে ।
যে গল্প টিকে আছে তা “বেনেট আরকান” দলের কাহিনী ।
ওয়াকার পাস এর খোঁজে ক্যাপ্টেন জেফারসন হান্টের দলচ্যুত হয়ে গভীর গিরিখাতটি পেরিয়ে গ্রুম লেক উপত্যকায় এসে স্মীথের দলটি যে দুটোভাগে বিভক্ত হয়ে যায় , তা নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে ? এখান থেকেই আবার টিকে থাকা আর একটি গল্পের শুরু ------
মিষ্টার বেনেট আর আরকান পরিবার সহ একটি দল ওয়াগনের মুখ ঘুরিয়ে ফেললো দক্ষিনে বহুদুরের বরফাচ্ছাদিত মাউন্ট চার্লসষ্টোনের পথে । তৃষ্ণার্ত নারী-শিশুদের জীবন বাঁচানোর পানির দেখা মিলবে ওখানে । মিলবে খাবার । আগেই তো ক্ষুধার্থ আর চলৎশক্তিহীন গরু আর খচ্চচরগুলিকে জবাই করে , রোদে পুড়ে নষ্ট হয়ে যাওয়া ওয়াগনের কাঠ পুড়িয়ে খাবারের সংস্থান করতে হয়েছে তাদের । বাকী চলনসই যা রইল তাই নিয়ে আবার পথে নামা । আদিগন্ত বিস্তৃত লবনাচ্ছাদিত তপ্ত উপত্যকা পেড়িয়ে চলার শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাওয়া দলটি ওয়ার্ম স্প্রীং ক্যানিয়ন হয়ে প্যানামিন্ট পর্বতশ্রেনীর সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল । এই পর্বতশ্রেনী পেড়ুতে হবে তাদের । হলোনা । পরিবারের নারীশিশুদের ভোগান্তি তখন চরমে । হাল ছেড়ে দিয়ে আবার ফিরে আসতে হলো সেই লবনাচ্ছাদিত তপ্ত উপত্যকাতেই । আশা বড় কুহকিনি । বাঁচতে চাই, বাঁচাতে চাই পরিবার – এই আশা নিয়ে উইলিয়াম ল্যুয়িস ম্যানলি আর জন রজার্স বাকীদের সেখানেই রেখে চললেন খাবার আর পানির খোঁজে । প্যানামিন্ট পর্বতশ্রেনী পেড়িয়ে গেলেই সিয়েরা নেভাদার দেখা মিলবে আর মিলবে খাবার ও পানি । শীঘ্রই ফিরে আসা যাবে এটা ভেবেই পা বাড়ালেন উইলিয়াম আর জন । তারপর ..... যেতে...যেতে ...যেতে । দিন গড়িয়ে মাস গেলে ৩০০ মাইল পাহড়ীপথ পাড়ি দিয়ে পৌছা গেল মিশন সান ফার্নান্দো’তে । খাবার আর পানি জোগাড় হলো, জোগাড় হলো ৩টি ঘোড়া আর একচোখ নেই এমন একটি খচ্চর । ফেরার পথে ক্লান্ত একটি ঘোড়া মরে গেল , বাকী দু’টোকেও ছেড়ে আসতে হলো পথের মাঝে । উইলিয়াম আর জন এর এতো পরিশ্রমেও শেষ রক্ষা হলোনা । ততোদিনে সোনা খোঁজার আশা ছেড়ে শিশু ও মহিলা সহ বেনেট আর আরকান পরিবারকে ফেলে রেখে বাকীরা যে যার মতো চলে গেছে এই অভিশপ্ত মরুভূমি পেড়িয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ।
ছবি – ৫ ------ বেনেট আরকান পরিবার ।
উইলিয়াম আর জন ফিরে আসবে জীবন ধারনের রসদ নিয়ে , এই গভীর বিশ্বাস বিধ্বস্ত বেনেট আর আরকান পরিবারকে দিয়েছে পথ চেয়ে থাকার শক্তি । উইলিয়াম আর জন ফিরে এলে এই দোযখের আগুন আর মৃত্যুসম ভয়াল অভিজ্ঞতার ভেতর থেকে বেঁচে আসা পরিবার দুটি যখন এই অভিশপ্ত মরুভূমি থেকে নতুন জীবনের সন্ধানে পা বাড়ালো তখন কেউ একজন নাকি এই বিভিষীকাকে বিদায় জানিয়েছিলো এই বলে – “ গুডবাই ডেথভ্যালী ” ।
সে-ই থেকেই তার নাম হয়ে যায় “মৃত্যু উপত্যকা” ।
আপনাদের অনেকেরই হয়তো ধারনা যে , এই উপত্যকায় গেলেই মৃত্যু অবধারিত তাই নাম ডেথভ্যালী । ধারনাটি যে ভুল, তা এতোক্ষন উপরের কাহিনীর সাথে হাটতে হাটতে আপনি বুঝে গেছেন নিশ্চয়ই ! তবে এখানে ছড়ানো ছিটানো আছে অনেক মৃত স্বপ্নের নিঃশব্দ ধ্বংসাবশেষ । এর মাটি আর পাহাড়ের বর্ণিলতার মতোই ছড়িয়ে আছে হাযারো রঙিন গল্প ।
নামের সাথে “মৃত্যু” কথাটি জড়িয়ে থাকলেও এই মৃত্যু উপত্যকায় যে প্রান বৈচিত্রের দেখা মেলে, প্রকৃতি এখানে যে মনোহর রূপে সাজিয়েছে তাকে, তা আপনার শ্বাস রূদ্ধ করে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট ।
ছবি – ৬ ----- শ্বাস রূদ্ধকর গোধূলির আকাশ নিয়ে পড়ে থাকা ব্যাডওয়াটার বেসিন ।
আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের দক্ষিনাঞ্চলের মোজাভ ডেজার্টের ৫৫০ বর্গমাইল জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে আছে এই মৃত্যু উপত্যকা । বৈরী কিন্তু ভয়ঙ্কর সুন্দর এই বিরান উপত্যকাটির ব্যাডওয়াটার বেসিন এলাকাটিতে আপনি যখন পা রাখবেন, জানবেন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৮২ ফুট নীচে আছেন আপনি । উত্তর আমেরিকাতে এটাই সর্বনীচু এবং পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণ এলাকা । একশ বছর আগে ১৯১৩ সালের জুলাই মাসে এখানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৫৭ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড । যা এ পর্য্যন্ত রেকর্ডকৃত পৃথিবীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা । বছরের ৬ মাস এই তাপমাত্রা ওঠানামা করে ৩৮ডিগ্রী থেকে ৪৮ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের মধ্যে । সারা বছরের গড়ে এই মাত্রা ২৫ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড । বুঝুন !
কেন এমনটা গরম এখানে ? বিশাল মরুময় প্রান্তরের মাঝে দাঁড়িয়ে আপনার এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবেন না । যদি স্যাটেলাইটের তোলা নীচের ছবিটি আপনি দেখেন, দেখবেন এলাকাটি একটি বেসিন বা গামলার মতো ।
ছবি – ৭-----স্যাটেলাইটের তোলা মৃত্যু উপত্যকার ছবি ।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৮২ ফুট নীচু হবার কারনে এবং চারদিক থেকে সুউচ্চ পাহাড় শ্রেনী একে আগলে আছে বলে , উপত্যকাটি লম্বাটে একটি গামলার আকার ধারন করেছে । এই গামলার তলদেশে সারা বছর আটকে থাকে ভারী বাতাস । ১১০০০ফুট উচ্চতার টেলিষ্কোপ চূড়া সহ এর চতুর্পাশ ঘিরে থাকা সুউচ্চ পর্বতশ্রেনী ডিঙিয়ে এই বাতাসের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ নেই । ফলে , সূর্য্যতাপ বাতাসের ফাঁদে আটকা পড়ে যায় । বৃষ্টিপাত প্রায় নেই বলেই শুষ্ক বাতাস আর লবন-বালুর মেঝে (বেসিন ফ্লোর), মোজাভ ডেজার্টের গনগনে সূর্য্যের তাপে রূটি সেকা প্যান এর মতো উষ্ণতা ছড়ায় । বেসিনের পাথরগুলো এতো গরম হয়ে থাকে যে আপনি এখানে দুপুরের খাবারের জন্যে ডিম ভেজেও নিতে পারেন ।
ছবি - ৮ ------- ডেথভ্যালীর পাথুরে মেঝেতে ডিম ভাজার দৃশ্য ……..
লবন ছাড়া ডিম মুখে তুলবেন কি করে ? কুছ পরোয়াঁ নহী । ডেথভ্যালীর মেঝে জুড়ে আছে ২০০ বর্গমাইলের সল্টপ্যান (salt pan) । লম্বায় ৪০ মাইল আর প্রস্থে ৫ মাইল । সেখান থেকে খানিকটা তুলে নিলে ক্ষতি কি ?
ছবি –৯ -------ডেথভ্যালীর মেঝেতে বিছিয়ে থাকা লবনের স্তর ।
আপনি এখন বলতেই পারেন, এই পোড়ার মরুভূমিতে লবন এলো কোত্থেকে ।
প্লেইস্টোসিন যুগে উত্তর আমেরিকার আইসক্যাপের বরফ গলে গলে এখানেই ছোট ছোট সাগরের জন্ম দিলে তাদের একত্রে নাম দেয়া হয়েছিলো “লেক ম্যানলি” । বরফ গলা শেষে মরুকরনের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া শুরু হলে এই লেকের সব পানি বাষ্পীভূত হয়ে যায় । পড়ে থাকে শুধু লবন আর লবন । আর পড়ে থাকে বোরাক্স (borax), সিলভার আর সীসা।
“গোল্ড রাশ” এর পরে ১৮৮৩ সাল থেকে ১৯০৭ সাল পর্য্যন্ত এই বোরাক্স উত্তোলনই ডেথভ্যালীকে করে রাখে মানুষের কোলাহলে মুখর ।
ছবি – ১০ . হারমোনি বোরাক্স ওয়র্কস ।
ছবি – ১১ হারমোনি বোরাক্স ওয়র্কসের খচ্চরে টানা গাড়ী ।
সোনা খুঁজতে আসা লষ্ট ফোরটি নাইনার্সের গল্পের সাথে এই যে এতোক্ষন ডিজিটালী ঘুরে এলেন সিয়েরা নেভাদার পথ , তা আপনি নিজে স্বশরীরে হেটে গেলে আপনাকে ধরতে হবে ডেথভ্যালী ন্যাশনাল পার্কের ভিতর দিয়ে যাওয়া হাইওয়ে- ৩৯৫ । অথবা হাইওয়ে- ১৯০ । আছে আরও পথ । যেদিকে যেতে চান সেদিকের ।
ছবি -১২ --- এই পথ যদি না শেষ হয় ........
ছবি -১৩ --- হাইওয়ে - ৩৯৫ ।
ছবি -১৪--- নাম ফলক ।
এখন আপনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন , সেখানেই হাযার বছর ধরে দাঁপিয়ে বেড়িয়েছে আমেরিকার আদিবাসী “তিমবিশা” গোত্র । “রেড ইন্ডিয়ান” শব্দটি সম্ভবত এই “তিমবিশা” নামটি থেকেই এসেছে । কারন “তিমবিশা” শব্দটির অর্থ - "Red Rock Face Paint"
ছবি – ১৫. তিমবিশা, রেড ইন্ডিয়ান ।
সাদা মানুষেরা এখানে পা রাখার আগে এই তিমবিশা গোত্র এখানেই বেড়াত শিকার ধরে আর পিনিওন পাইন বাদাম ও মেসকুইট বীন চাষ করে । এই মাটিতেই তাদের সব প্রয়োজন মিটতো বলে উপত্যকাটি ছিলো এক পবিত্র ভূমির মতো । বিজাতীয় মানুষেরা পবিত্র ভূমিকে অপবিত্র করে বসতি গাড়বে, এটা পছন্দ হয়নি বলে ধূঁ-ধূঁ বালিয়ারীতে দিশেহারা ভাগ্যান্বেষী অসংখ্য সাদাকালো মানুষদের প্রান খোয়াতে হয়েছে তাদের হাতে । ধারনা করা হয়; শুরুর গল্পে যে স্মীথ, লিটল ওয়েষ্ট আর জো এর কথা জেনেছেন তারাও এই রেড ইন্ডিয়ানদের হাতেই মারা পড়েন ।
আজ আর সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই । তবে আছে কিছু গল্প আর স্বপ্নের সমাধি । আছে ফেলে রাখা স্মৃতি । আর আছে ফার্নেস ক্রীক নামের উপত্যকায় কিছু তিমবিশা রেড ইন্ডিয়ান ।
ডেথভ্যালী এখন “ডেথভ্যালী ন্যাশনাল পার্ক” । ১৯৩৩ এর ১১ই ফেব্রুয়ারী প্রেসিডেন্ট হার্বার্ট হুভার মূল উপত্যকা সহ আশেপাশের জায়গা নিয়ে “ডেথভ্যালী ন্যাশনাল মনুমেন্ট” এলাকা হিসাবে ঘোষনা করেন । ১৯৯৪ সালে এর বিস্তৃতি আরো বাড়িয়ে পুনঃনামকরন করা হয় “ডেথভ্যালী ন্যাশনাল পার্ক” ।
এখন এর জেল্লা গেছে বেড়ে । পথশ্রান্ত পথিক এখানে পাবেন বিভিন্ন রিসোর্ট । মৃত্যু উপত্যকায় জীবনের পরশ ।
ছবি –১৬ --- প্যানামিন্ট স্প্রীং রিসোর্ট ।
ছবি –১৭ -- ফার্নেস ক্রীক রিসোর্ট ।
ছবি –১৮ --- ফার্নেস ক্রীক র্যাঞ্চ ।
ঘুরে আসতে পারেন ডেথভ্যালীর সর্ব উত্তরের গ্রেপ-ভাইন ক্যানিয়নের সবুজ মরুদ্যানে লুকিয়ে থাকা অনেক গল্পের জন্মদাতা “ স্কটি’জ ক্যাসেল” থেকে ।
ছবি – ১৯ -- স্কটি’জ ক্যাসেল
পথ চলতে চলতে দেখে আসুন লষ্ট ফোর্টিনাইনার্সের স্বপ্নের স্বর্ণতীর্থ “সাটার’স মিল” জায়গাটি ।
ছবি – ২০ -- সাটার’স মিল স্মৃতিফলক ।
এই স্মৃতি ফলকটি দেখতে দেখতে ক্যালিফোর্নিয়ান গোল্ডরাশের সেই সব দিনগুলোর কথা ভাবুন একবার । শত শত মাইল এবড়ো থেবড়ো পাহাড়ের ঢাল, আদিগন্ত গনগনে বালুময় মরুভূমি , গোত্তা খাওয়া ক্যানিয়ন পেড়িয়ে ছুটে আসা মানুষের ঢল । বয়ে চলা নদী আর ঝর্ণার জল ছেকে ছেকে সোনালু কনা তোলার হিড়িক । তিরতির বয়ে যাচ্ছে পাহাড় থেকে নেমে আসা স্রোতস্বিনী । তারই জলে দিনরাত শরীর ভিজিয়ে ছাঁকুনী হাতে ছেঁকে তোলা বালুমাটির দিকে তৃষিত চোখে চেয়ে আছে এই বিজন প্রান্তে মৃত্যু ঝুকি নিয়ে আসা মানুষগুলো । সোনালী কিছু ঝিলিক দিয়ে উঠলো কি ?
ছবি - ২১ স্বর্ণ সন্ধানে .........
তারপর ? প্রতীক্ষিত সোনার খনির দেখা মেলা ।
যে সোনার খনির পথ চেয়ে কেটেছে হাযারো ভাগ্যান্বেষী মানুষের দিন। তেমনি একটি সোনার খনি ; ডেথভ্যালীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ আর বেশী উত্তোলন যোগ্য “কিয়েন ওয়ান্ডার মাইন” । গোল্ড রাশের মূল আকর্ষন । এখনও এমনটাই দেখতে পাবেন আপনি বাইরে থেকে । সেই আগের মতো । বহু দুর থেকে এলেও ডেথভ্যালী ন্যাশনাল পার্কের রক্ষনাবেক্ষনকারীর দল আপনার ভেতরে ঢুকে ঘুরে ঘুরে দেখার আশাটি পুরন হতে দেবে না । নিরাপত্তার কারনে আপনার এখন ভিতরে ঢুকতে নিষেধ আছে তাদের ।
ছবি - ২২ -- কিয়েন ওয়ান্ডার মাইন ।
আপনার চোখে এটাকে ভুতুড়ে মনে হবে । নির্জন, পরিত্যক্ত । ঢুকতেই যখন পারা যাচ্ছেনা তাই ওদিকের কথা না ভেবে পা বাড়ান সোনার খনির মতো ভুতুড়ে নির্জন আরো যে অনেক শহর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই মৃত্যু উপত্যকায়, সেদিকে । যেখানে সেদিনগুলির মানুষের ভেঙে যাওয়া স্বপ্নের নিথর ধংশাবশেষ দেখতে পাবেন আপনি ।
ছবি - ২৩ -- ডেথভ্যালী ঘোষ্ট টাউন ।
“আমার বিশ্বাসই হচ্ছেনা ফ্রিসকো এই অল্প সময়ের মধ্যেই এখন এক মৃত শহর । ভাবতেই পারিনা, এই ক’দিন আগেও যেখানে লাইন ধরে আমরা খাবার আর মদ গিলেছি সেই পানশালাগুলোর ভেতর এখন পেঁচারা উড়ে বেড়ায় ! আমাদের হেটে চলা পথ এখন আগাছার জঙ্গল ।” - এই ছিলো ১৯৩০ সালে “ট্যুরিং টপিকস” এ সাক্ষাৎকার দেয়া ফ্রাঙ্ক শর্টি হ্যারিসের বিস্ময় । ডেথভ্যালীর ভুতুরে শহরগুলো সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন এমনটাই ।
ছবি - ২৪ -- ফ্রাঙ্ক শর্টি হ্যারিস (উপরে) আর নীচের ছবিতে ওয়াল্ট স্কটি ( খচ্চরের পিঠে ) আর শর্টি ।
কে এই ফ্রাঙ্ক শর্টি হ্যারিস ? সে সময়কার ডেথভ্যালীর একজন কিংবদন্তীর ল্যান্ড প্রসপেক্টর ।ছোটখাটো একটি মানুষ । রোড আইল্যান্ডে জন্ম নিয়ে সাত বছর বয়সেই এতিম । ১৪ বছর বয়সে ভাগ্যান্বেষনে পশ্চিমে আসা তার । লেডভাইল , কলোরাডো, টম্বষ্টোন, আরিজোনা ঘুরে অবশেষে থিতু হওয়া ডেথভ্যালীতে । খর্বাকৃতির জন্যে নাম হয়ে যায় “শর্টি” । ডেথভ্যলীর অনেক সোনার খনিই শর্টির আবিষ্কার । শর্টি নাকি বাতাসে সোনার গন্ধ খুঁজে পায়, এমন কিংবদন্তী ছড়িয়ে আছে ডেথভ্যালীর মানুষের মুখে মুখে । কিন্তু গোল্ড মাইনিংয়ে জড়িয়ে পড়েন নি বা খনি মজুরের কাজ করেননি কখনও । শুধু পশ্চিমের সেলুনগুলিতে বসে গল্প বলা আর মদ গিলে চূর হয়ে থাকাতেই ছিলো তার আনন্দ । তার বলা গল্পগুলিই তাকে মৃত্যু উপত্যকার “হিরো” বানিয়ে রেখেছে আজও ।
৭৮ বছর বয়সে ক্যালিফোর্নিয়ার বিগ পাইন এলাকায় নিজ কেবিনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন এই মানুষটি । মৃত্যুর আগে শেষ ইচ্ছে জানিয়ে ছিলেন , তাকে যেন মৃত্যু উপত্যকার মাঝখানে দাফন করা হয় । আর তার শিয়রের পাথর ফলকে যেন লেখা হয় এই এপিটাফটি ----- “ হিয়ার লাইজ শর্টি হ্যারিস, আ সিঙ্গল ব্লাঙ্কেট জ্যাকএ্যাজ প্রসপেক্টর ১৮৫৬ – ১৯৩৪ ।”
ছবি - ২৫ -- রিয়োলাইট ঘোষ্ট টাউন ।১৯০৫ এ নব্বই হাযার ডলারে নির্মিত তিন তালা ব্যাংকের ভুতুরে কাঠামো ।
একশত বছর আগে দশ হাযারের ও বেশী মানুষের পদভারে মুখরিত ছিলো যে রিয়োলাইট শহরটি, মাত্র একযুগের মধ্যেই তা বিরান । ১৯০৪ এর আগেও পাহাড়ে পাহাড়ে ছিল আকরিক কোয়াটর্জ এর ছড়াছড়ি । তাতে মেশানো ছিলো সোনা । জুটে গেলো সোনাখেকো লোক । ২০০ ল্যান্ড ক্লেইম জমা পড়লো । বসলো কোয়াটর্জ পরিশোধন ফ্যাক্টরী । এলো বিদ্যুত । গড়ে উঠলো ব্যাংক , ষ্টক এক্সচেঞ্জ , বোর্ড অব ট্রেড । জমজমাট এই শহরের আর এক নাম হয়ে গেলো “ দ্য কুইন সিটি ” । ১৯০৭ সালে শুরু হলো অর্থনৈতিক ধস । ১৯১২ সালের ভেতরেই ভুতুরে হয়ে গেলো শহরটি । ফার্নেস ক্রীক ভিজিটরস সেন্টার থেকে হাইওয়ে – ৩৭৪ ধরে উত্তর দিকে ৩৫ মাইল দুরে গেলেই আপনি পৌঁছে যেতে পারবেন এই ঘোষ্ট টাউনের একদম মাঝখানে ।
ছবি - ২৬ -- ওয়াইল্ডরোজ কিল্ন ।
এবারে উপরের ছবিটিতে এস্কিমোদের বাড়ীর মতো দেখতে কিম্ভুত কিমাকার স্থাপনাগুলোর চারপাশ ঘুরে আসুন । ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়েষ্ট এর সু - সংরক্ষিত পুরোনো যা কিছু আছে তার ভেতরে এই ওয়াইল্ডরোজ কিল্ন একটি । মৌচাকের মতো আকৃতি নিয়ে ২৫ ফুট উঁচু এই দশ দশটা কয়লা পুড়িয়ে সিলভার আর সীসা গলানোর ভাঁটি আমাদের দেশের ইটভাটার কথা মনে করিয়ে দেবে আপনাকে । ১৮৭৭ সালে বানানো হয়েছিলো এগুলো । ১৮৭৯ এর পরে এগুলো আর ব্যবহার করা হয়েছিলো কিনা তার কোন হদিশ নেই । তাই এগুলো এখনও টিকে আছে গায়ে গতরে অনেকটা আগেরই মতো । প্যানামিন্ট পর্বতশ্রেনীর পশ্চিম অংশে ওয়াইল্ডরোজ ক্যানিয়নে এগুলো দেখতে পাবেন আপনি । কয়লা পোড়ানো গন্ধও লেগে আছে তার গায়ে আজও ................
ছবি, তথ্য ও সূত্র – ইন্টারনেট ।
চলবে ---------