স্বপ্ন আর তার লক্ষ্যস্থলের মধ্যের রাস্তা সব সময় ট্যাড়া বেঁকা হয় । এ রাস্তা কখনও সোজা নয় । সোজা হতে দেয়াও হয়না । তবুও মুশকিল হলো – স্বপ্ন দেখা থেমে থাকেনা ।
তাই আজকাল ব্লগে অনেক সচেতন ব্লগারদের লেখাতেই স্বপ্ন ভঙ্গের একটা হতাশা ফুঁটে উঠতে দেখি । হতাশা দেশ নিয়ে, হতাশা আগামীর পথ চলা নিয়ে , হতাশা ভবিষ্যত প্রজন্মের সামনের দিনগুলো নিয়ে । বিভিন্ন বিষয়ের উপরে তাদের দেয়া পোষ্ট থেকে যা ছেঁকে তোলা যায় তার সার এগুলোই । কেউ রাজনীতি নিয়ে , কেউ রাষ্ট্রীয় কোনও নীতি নির্দ্ধারন নিয়ে, কেউবা অন্য দেশের গৃহীত কোনও পদক্ষেপের উদাহরন টেনে আমাদের দেশের সাথে তুলনা করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন । কেউ সরাসরি আমাদের রাজনীতি আর রাজনীতিকদের দোষারোপ করেন, কেউ করেন আমাদের মানসিকতার । কেউবা করেন রাষ্ট্রীয় নীতি নির্দ্ধারকদের । এর সবগুলিই যে সত্যি এমোন ধারনার সাথে আপনাদের অনেকের মতের মিল হবে সন্দেহ নেই । কিন্তু সবার উপরে সত্য যেটি তা হলো – “আমরা জনগণ” । এটি কিন্তু কেউই মানতে চাননা । প্রত্যেকটি ঘটনার যেমন একটি শুরু থাকে তেমনি আমাদের এই দুরবস্থারও একটি শুরু আছে । আমরা জনগণ সেই “শুরু” । এ প্রসঙ্গেই চলে আসে উপরের শিরোনামটি । আপনার দেশটিই যদি আপনার মূখ্য ভাবনার বিষয় হয়ে থাকে তবে “ভোট” সম্পর্কে আপনার প্রশ্নটি কি হবে ?
প্রশ্ন সব সময়ই আগে আসে । উত্তরটি আসে ধীরে সুস্থ্যে নিজের মতো করে । আমি এখানে উত্তরটি আগে দিয়ে দিয়েছি । এবার প্রশ্নটি আসুক ভেবে চিন্তে -
আমাদের হতাশা আর দীর্ঘশ্বাস ফেলার শুরুটা হয় “ভোট” দেয়ার মধ্যে দিয়ে । যার অংশগ্রহনকারী আমরা জনগণ, আবার কিছুদিনের মধ্যেই দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে হেচকিও তুলে ফেলি আমরা জনগণই । যার কেচ্ছা কাহিনী ব্লগের পাতাতে তো বটেই পত্র-পত্রিকাতেও আমরা প্রতিদিনই দেখতে পাই । প্রতিদিনের খবরের কাগজের পাতাতে আমাদের স্বপ্নপুরনের কোন কথা নেই বরং স্বপ্ন ভঙ্গের ফন্দিফিকিরেরই জয়গান সেখানে । দেশের দক্ষিনাঞ্চলে একটি পুরোনো প্রবাদ আছে –
“ ডিম পাড়ে হাসে, খায় বাঘডাঁশে (বড় বন-বেড়াল)” ।
রসিকতা করে বলা হলেও কঠিন একটি সত্য ধরা পড়েছে এতে । আপনার পরিশ্রমের ফসল চলে যাচ্ছে অন্যের পেটে, এই সরল সত্যটিই প্রবাদটির উপপাদ্য ।
এ প্রসঙ্গে একটি মজার কাহিনী বলি । আপনাদের বুঝতে সুবিধে হবে ।
অনেকদিন আগে জনাব শফিক রেহমান ( আমার শ্রদ্ধেয় )সম্পাদিত “যায় যায় দিন” সাপ্তাহিকের জন্যে একটি লেখা দিয়েছিলাম প্রকাশার্থে । বিষয়বস্তু ছিলো, যেকোনও ধরনের ভোট , বিশেষকরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পালাবদলের সময়টিতে অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচনে প্রদত্ত হলে তা জনগনের আকাঙ্খা পুরনে সহায়ক হয় কিনা কিম্বা তা থেকে আমাদের মতোন দেশের সাধারন মানুষের আদৌ কোনও ফয়দা হাসিল হয় কিনা ইত্যাকার আলোচনা।
লেখাটি পাঠানো হয়েছিলো ২০০১সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে আগে। সেই সময়কালে শ্রদ্ধেয় জনাব রেহমান ব্যস্ত ছিলেন দেশের এককোটি নব্যতরুনকে একটি সুখপাঠ্য লেখার কাজে । উনি দেশের তরুন সমাজকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন “ভোট” দিয়ে একটি বিপ্লব সাধন করতে । উনি আরো বলেছিলেন যে, “১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের পর ৩০বছর পেরিয়ে গিয়েছে । অথচ এখন পর্যন্ত কোনও সরকার তোমাদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ ও নিশ্চিত করতে পারেনি ।......কোন ও নেতাই তোমাদের সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারেনি ।”
তাই সঙ্গত ভাবেই আমার লেখাটির বিষয় বস্তুর কারনে তাঁর পক্ষে সেটি প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি । কারন ভোট বলে কথা - ভোট যে দিতেই হবে !
আপনাদের স্মৃতিবিভ্রাট না হলে নিশ্চয়ই মনে আছে তাতে কাজ হয়েছিলো । সেই সময়কালের এককোটি তরুন একটা নিরব ভোট বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছিলেন । জনার রেহমানের ইচ্ছে পুরন হয়েছিলো , তরুনদের কথা মতো আওয়ামী লীগের অসৎ নেতৃত্বের বিপক্ষে সৎ নেতৃত্বের বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন তারা ।
আমার ছাপার মুখ দেখতে না পাওয়া লেখাটির বিষয়বস্তু ছিলো, বাংলাদেশের অতীত ও বর্তমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি যাবতীয় ‘নৈতিক’প্রেক্ষাপটে সাধারন জনগণের জন্যে ভোটপ্রদান কোনও প্রকার সুফলতা বয়ে এনেছে কিনা কিম্বা ভবিষ্যতে আনবে কিনা তার বয়ান । আর এই ভোট প্রদান করতে গিয়ে ভোটার যে দায়ভার মাথায় তুলে নেন তার বোঝা ভোটার কোনদিন বইতে পেরেছেন কিনা তাও । এই বক্তব্যের কারনেই জনাব রেহমানের পক্ষে সেদিন আমার লেখাটি ছাপতে দেয়া সম্ভব হয়নি । কারন, ভোট দেবেন না ; এমোন কথা লিখলে যে দেশেই টিকতে পারতেন না উনি ।
কিন্তু ইতিহাস কাউকে ছেড়ে কথা কয়না । শ্রদ্ধেয় জনাব রেহমানের আবেদন ছিলো, একটি পরিবর্তন যা এদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করবে , দেবে নিরাপত্তা , দেবে বাঁচার গ্যারান্টি । তার এই আকুল আবেদন আর কোটি তরুনের তাতে সাড়া দেয়া , এইদু’টি প্রচন্ড শক্তিশালী প্রক্রিয়াও ‘‘আমার ভাই – তোমার ভাই”জাতীয় জনগণের সেবা করতে করতে মৃতপ্রায় মুষ্ঠিমেয় জনহিতৈষী (?) প্রানীদের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে অবব্যহিত পরেই । নিয়তির কি নিষ্ঠুর পরিহাস, দু’বছর ঘুরতে না ঘুরতেই “যায় যায় দিন” পত্রিকাতেই আবার তাঁকে হতাশার সুরে অনেক লেখা লিখতে হয়েছে । সেই সময়ের “যায় যায় দিন” সাপ্তাহিক পত্রিকার বর্ষ: ১৯ ,সংখ্যা: ৩১ এ তারই সুযোগ্য কলামিষ্ট জনাব মাহতাব কায়সারকে লিখতে হয়েছে – “সাধারন ভোটাররা যে বিপুল আশা নিয়ে ভোট দিয়েছিলেন তার বহুকিছুই তারা পুরন করতে পারেনি । এতে অনেক ভোটারই ক্ষুব্ধ হয়েছে......” । তিনি আরো লিখেছেন, “…বাস্তব অবস্থা দেখে তারা শুধু হতাশই হচ্ছেনা, বরং আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে ।”
অর্থাৎ আপনার ভোটে পাড়া ডিমটি জনপ্রতিনিধি নামক “বাঘডাঁশে” খেয়ে ফেলেছে !
আসলে শতশত তরুন সেদিন ভোট কর্মে যে পরিবর্তন ঘটিয়েছে তা কেবল মুদ্রার এপিঠটাকে ঘুরিয়ে ঐপিঠ করে দিয়েছে । দেশ এক তিমির অন্ধকার থেকে আরো গভীর তিমিরে নিমজ্জিত হয়েছে । তার ধারাবাহিকতায় পিষ্ট হতে হতে আজকে আমাদেরই মালিকানাধীন রাষ্ট্রটিতে আমরা দাসানুদাস হয়ে নতজানু অবস্থায় আছি । জীবন–জীবিকার প্রশ্ন , সন্তানের ভবিষ্যত, অনেক কষ্টে টিকিয়ে রাখা প্রানখানি হাতের মুঠোয় ধরে দিন পার করছি আতঙ্কিত হয়ে । উদাহরন দিতে হবে ? মনে হয়, না ! আজকাল পত্রিকার পাতা খুললেই লুটপাটের যে চিত্র আপনার চোখে পড়ে তাতে সবকিছু কাঁপিয়ে দিতে আপনার ইচ্ছে করেনা ?
এই যে ‘আতঙ্কিত’হবার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হওয়া, এটা তো হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর শ্রেনী স্বার্থে | তাদের কায়েমী সুবিধা বজায় রাখতে শাসন ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় তাকে তো পাশ করতেই হবে । সেকারনে একটা হুলস্থুল জাতীয় আবহাওয়া তৈরীর মধ্যে দিয়েই তারা নেমে পড়েন ভোটযুদ্ধে । আর আমরাই সে ভোট যুদ্ধের আয়োজক এবং অংশগ্রহনকারী । নিজের পায়ে নিজে কুড়োল মারার এমন নজির আর দ্বিতীয়টি নেই । এভাবেই আমরা মূর্খ জনগণ নিজেরা বেগার খেটেখুটে রাজমুকুটটি তাদের মাথায় তুলে দেই । ভোটে পাস এই ‘সার্টিফিকেট’টি তাদেরই হাতে তুলে দিয়ে তাদের বসতে দিয়েছি শাসক আর শোষকের আসনে ।
এই যে আতঙ্কিত হওয়া এর কারন নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয় ? গনতন্ত্রের প্রথম পাঠ – “ অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল এ্যান্ড ফর দ্য পিপল” এর বদলে আজকের “অব মি, বাই মি, ফর মি” র গনতন্ত্রে এটাই একমাত্র ফলাফল । এই সত্যটি জেনেও আপনি কিন্তু ব্যালট পেপারে একখানা সীল ঠুকে দিয়ে “ নাগরিক অধিকার” বজায় রেখেছেন এই খুশিতে বাগবাগ হয়েছেন । ভেবেছেন দেশ এবার উন্নতির জোয়ারে ভাসতে থাকবে । কিন্তু সবই গুড়ে বালি ।
আপনার ৪০ বছরের দেখা সত্যকে পাশ কাটিয়ে প্রতি পাঁচ বছর পরপর আপনারই দেয়া ভোটে যে আশার আলো ফুটবে বলে আপনি প্রত্যাশা করেছিলেন তা ‘ফর মি, বাই মি’র গনতন্ত্রের যাতাকলে পড়ে গুড়োগুড়ো হয়ে গেছে । আমাদের ষ্টাইলের গনতন্ত্রে এটাই “একমাত্র ভাবে” অবশ্যম্ভাবী । এটা দেখেশুনেও আপনি বারবার ভোটের সময় এলে নড়েচড়ে বসেছেন । ভেবেছেন, গেলবার অমুক দলে ভোট দিয়ে দেখেছি তারা শুধু অপকর্মই করেছে, নিজেদের আখের গুছিয়েছে তাই এবার তমুক দলকে ভোট দেবো । সেই তমুক দলটিও আপনার মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খেয়ে গেছে । তারা আরো বেশী করে আখের গুছিয়েছে কারন তারা জানে পরের বার অর্থাৎ আগামী পাঁচ বছরে লুটপাটের মসনদে আর বসা যাবেনা । তাই আপনি আগের থেকে আরো বেশী যাতাকলে পিষ্ট হয়েছেন । তারপরএ আপনি থেমে থাকেননি, আবার পরবর্তি ভোটের লাইনে দাঁড়িয়েছেন । আপনার অবচেতন মনে ‘ভোট’ যেন একটি অবসেশন হয়ে দাঁড়িয়েছে আর এর বাইরে আপনি যেন অন্য কিছু ভাবতেই পারছেন না ।
আমরা ন্যাড়ার দল যে বেলতলায় একবার না গিয়ে বারবার যাচ্ছি, আমাদের এমোন কান্ডকারখানা দেখেই গণতন্ত্রের পুজারীরা বুঝে গেছেন, নির্বোধ জনগণকে একবার ভোটের লাইনে দাঁড় করাতে পারলেই ‘‘ফর্ মি” র গণতন্ত্র রক্ষা পাবে এবং এটাই তাদের একমাত্র রক্ষা কবচ। এই তথাকথিত গণতান্ত্রিক সভ্যতার ধ্বজাধারীরা যে মেকী মানসিকতা তৈরী করে দেয় জ্ঞানচক্ষু উন্মীলনের মূহুর্তে তা থেকে আমাদের মুক্তি নেই মৃত্যু পর্য্যন্ত। আর তাইতো গনতন্ত্রের পূঁজারীরা ওয়াজ নসিহৎ করতে পারছেন এই বলে যে ‘ ভোট দেয়া নাগরিক অধিকার ’। হ্যা , অনেক অধিকারের মতো এটাও আপনার একটি অধিকার । কিন্তু মৌলিক নয় ।
ভোট সর্বস্য এই রাজনীতিতে আমরা কি পেয়েছি ? প্রাপ্তির ফিরিস্তি লম্বা হবে বলে লেখাটির কলেবরের খাতিরে ফিরিস্তি কমিয়ে সামান্য উদাহরন দিতে চাই –
গনতন্ত্র পেয়েছি বলে আনন্দে বগল চাপড়ানো একদল সুবিধাবাদী সুশীল শ্রেনী পেয়েছি । দেশের সম্পদ লুট এবং রাষ্ট্রীয় কোষাগার উজার করে পয়দা হওয়া হাযার খানেক কোটিপতি পেয়েছি । আর “ভাত দে হারামযাদা” বলা এক জনগোষ্ঠী পেয়েছি যাদের কাছে “রোটি-কাপড়া অওর মকান” না থাকলেও “ভোট” নামের একটি শক্তিশালী সম্পদ রয়েছে যার ব্যবহার সে জানেনা !
একবার ভাবুন- যে দেশে সামান্য পাঁচ দশ হাযার টাকার কৃষিঋন অনাদায়ে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমকারী কৃষকের কোমরে দড়ি বেঁধে জেলখাটানো হয় , যে দেশে সত্যিকারের ব্যবসায়ীরা জামানতসহ প্রোজেক্ট প্রোফাইল জমা দিয়েও এককোটি-দু’কোটি টাকা ঋন পাননা , যেখানে উচ্চশিক্ষিত-মেধাবী-সৃজনশীল তরুনরা নিজ উদ্যমে ছোটখাট একটা ব্যবসা দাঁড় করাতে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে ঘুরেও সামান্য কয়েক লাখ টাকা ঋন জোটাতে পারেন না , যেখানে কর্মসংস্থানের নিমিত্তে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় সহ ব্যাকিং সেক্টরের মাথাদের সহানুভূতি জোটেনা অথচ নাম না জানা এক ব্যক্তি হাযার হাযার কোটি টাকা ঋন পেয়ে যান অনায়াসে, সমবায় ব্যাংকিং এর আড়ালে অপদার্থ জনগণের টাকার হরিলুট হয় আর তা দিয়ে সুরম্য প্রাসাদ কেনা হয় এই অভাগা দেশ থেকে অনেক দুরের আপনার স্বপ্নের দেশগুলোতে; এমোন একটি রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে আমরা বসে আছি । এক এগারোর চিহ্নিত লুটেরাদের ছেড়ে দিতে রাজপথে আন্দোলন করার রাজনৈতিক জঠিল সংস্কৃতির মধ্যে আমরা বেঁচে আছি । টাকার বস্তা সহ হাতেনাতে ধরা পড়ার পরেও মিডিয়ার বিরুদ্ধে মামলা ঠোকার মানসিকতা পোষন করার মতো নির্লজ্জ লোক দ্বারা রাষ্ট্রীয় ভাবে প্রতিনিধিত্ব হচ্ছি । দূর্নীতি করেও দেশ প্রেমিক হিসাবে আখ্যায়িত হওয়া যায়, আখ্যাও দেয়া যায় ; এমোন বাস্তবতার সাথে আমাদের বসবাস । আমাদের চেয়ে অভাগা আর কে আছে ? এগুলো আমাদেরই অজ্ঞতায়, আমাদেরই অসচেতনতায়- অবহেলায়, আমাদেরই অজান্তে তৈরী হওয়া একটি ফ্রাঙ্কেনষ্টাইন।
কেন ? কারন, আমাদেরই দেয়া সার্টিফিকেটটি নিয়ে তারা আমাদের প্রতিনিধি নয় বরং আমাদেরই দেয়া ক্ষমতা বলে আমাদের সবকিছু চুষে খাওয়ার মৌরসী পাট্টা নিয়ে নিয়েছেন । আর এ জন্যেই সমাজের ক্ষমতাভোগী শ্রেণী , যখনই সকল সুবিধা ভোগের ‘ মৌরসী পাট্টা ’ লাভে কোনও না কোনও ভাবে শংকিত হয়েছেন তখনি ভোট তন্ত্রের সংস্কৃতি চালু করে দিয়েছেন। আর আমরা আবারো গিয়ে দাঁড়িয়েছি ভোটের লাইনে । ভাত-কাপড়ের লাইনে দাঁড়াইনি কারণ ভাত-কাপড়ের অধিকার আদায়ের ডাক কেউ দেয়নি- দেয় ও না। এবং এ করেই আমাকে প্রতিপালনের যাবতীয় ক্ষমতা তুলে দিয়েছি সেই শ্রেণীর হাতে যে শ্রেণী কোন অবস্থাতেই ‘সাধারন মানুয়ের’ প্রতিনিধিত্ব করেননি। সমাজবিদরা আৎকে উঠবেন আমার এ বিশ্লেষনে। প্রশ্ন তুলবেন - ভোটে নির্বাচিত লোকজন ভোটারের প্রতিনিধিত্ব করেনা, এটা কোন ধরনের আহাম্মকী কথা ! জবাবে বলছি, শাসক শ্রেনী কোন অবস্থাতেই শোষিতের প্রতিনিধিত্ব করেনা। এটা রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত সত্য। আমরা ভোট দিয়ে আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপটে এক একটি ‘শাসকশ্রেণী ’ ই তৈরী করেছি বারংবার, প্রতিনিধি নয়। খুচরো-খাচরা কিছু ইস্যু ছাড়া কোন অবস্থাতেই তারা আমাদের প্রতিনিধিত্ব করেননি।
আপনি মুখেমুখে তর্ক করলেও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন এই বাস্তব সত্যটি, এর জ্বালাটি । তাই আজ আপনার দুধের শিশুটির দুধের বাজেট কমিয়ে আপনাকে বিদ্যুত বিল, গ্যাসের বিল ভরতে হচ্ছে । সামনে আরো অনেক কিছুই আপনাকে ভরতে হবে !
তাহলে এর সমাধান কোথায় ?
সমাধান হয়তো হতে পারে – ভোট থেকে দুরে সরে থেকে । কেউ হয়তো বলবেন এতে তো আমার ভোটের অধিকার রক্ষিত হলোনা । তাদের ভেবে দেখতে বলি, গেল চল্লিশ বছরে সেই ভোটের অধিকার রক্ষা করেই বা পেয়েছেনটা কি, আপনার হয়েছেটাই বা কি ?
এখন বলতে পারেন , এজন্যে কয়টি নির্বাচন থেকে দুরে থাকতে হবে ভোট না দিয়ে , লাগবে কয় বছর ? জনাব রেহমানের কথাতেই বলি, “ত্রিশ বছরেও যখন আমরা কিছুই পাইনি” তখন আরো দশটি বছর না হয় দেখলাম । এ সময়ের মধ্যে দু’টি নির্বাচন ঠেকাতে পারলেই হবে । আসলে কি এতো সময় লাগবে ? লাগবে না । কারন কোনও অনির্বাচিত বা জন-সমর্থনহীন সরকারের (রাজনৈতিক বা সামরিক)পক্ষেই বেশীদিন মসনদ আগলে থাকা সম্ভব নয় । উদাহরন দেবেন এই বলে যে, সামরিক সরকার গুলো তো অনেক বছর ক্ষমতায় থেকে গেলো । ভালো করে ভেবে দেখুন কেন সেটি সম্ভব হয়েছে । হয়েছে, কারন এক শ্রেনীর লেজুড়বৃত্তিকারী ক্ষমতালোভী লোক উর্দিপড়া ব্যক্তিটিকে "পাবলিক ড্রেস " পরিয়ে রাজনীতিতে নামতে সাহায্য করেছে এবং যেনতেন প্রকারে একটি “ভোট নাটক” মঞ্চস্থ করে তার মসনদ পাকা করে দিয়েছে আর নিজেরা হালুয়া-রুটির ভাগ নিয়েছে ভোটে পাওয়া রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জোরে । অর্থাৎ এক্ষেত্রেও “ভোট” নামের একটি মারাত্মক এবং একমাত্র সহায়ক অস্ত্রটির সাহায্য নিতে হয়েছে । এরাই যদি জানতেন ভোটের মাঠে গুটি কয়েক কাক-পক্ষী বাদে আর কোনও কাক-পক্ষী উড়বেনা তখন গদি বাঁচাতেন কি করে ?সোজা কথায় ভোট হলো একটি সার্টিফিকেট যা না থাকলে কোনও হাটে বিকানো যাবেনা ।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, ভোট থেকে দুরে সরে থাকলে লাভ কি ? কেউ না কেউ তো ভোট দিতে যাবেই । ঠিক । কিন্তু কারা যাবে ? যারা যাবে তারা কেবলমাত্র স্ব-স্ব রাজনৈতিকদলের কর্মীরা এবং প্রার্থীদের আত্মীয়েরা । এরা সংখ্যায় কতো ? সর্বোচ্য ১০% । তাহলে যেখানে ৪০ থেকে ৫০% ভোটারের উপস্থিতিতে বিশ্বজুড়ে হৈচৈ পড়ে যায় নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে সেখানে এই ১০ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতি কি কোনও তথাকথিত বিজয়ীকে বৈধতা দেবে ? সমগ্র ভোটারের সংখ্যার তুলনায় এই সংখ্যা কি তাকে বৈধতা দেয়ার জন্যে যথেষ্ট ?যেখানে ৯০% ভোটারই ভোট প্রদানে বিরত ?
বলবেন, এরপরেও তারাই গায়ের জোরে থাকবে । যদিও ইতিহাস সে কথা বলেনা । তাহলেও ভেবে দেখুন, গায়ের জোরে থেকে গেলে আমাদের যে দফারফা । এক্ষেত্রে আমাদের শ্বান্তনা শুধুমাত্র এই যে, তাদের কৃতকর্মের দায়ভার আমাদের নয় । আমাদের যে দফারফা হচ্ছে সেটি সম্পূর্ণ অবৈধ একটি কাজ । আর নির্বাচিত সরকারের কাছে আমরা কি এই দফারফা অবস্থা থেকে ভালো আছি, না ছিলাম কোনওকালে ? এই ক্ষেত্রে আমাদের কোনও শ্বান্তনাই নেই কারন ভোটটি দিয়ে সরকারের সব কাজকে তো আমরা বৈধতা দিয়ে দিয়েছি সুতরাং আমরাও তার জন্যে দায়ী ।
এখানে আমি একটি মেসেজই দিতে চাচ্ছি, “ ইট ইজ দ্য আলটিমেট রেজাল্ট দ্যাট কাউন্টস” ।
প্রতিদিন মেঘনা-যমুনা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে যাচ্ছে । ঘোলা জল আর তার তান্ডব যে দিনে দিনে বাড়ছে তা আমরা সবাই যেমন দেখতে পাচ্ছি দেখতে পাচ্ছেন আপনিও । আপনার কি মনে হয়না, সেই জলের তোড়ে আমরা সবাই গলা পর্য্যন্ত ডুবে গেছি ? আর ক’দিন বাকী সবটুকু তলিয়ে যেতে ?
ভোট দেয়া যদি আপনার গনতান্ত্রিক অধিকার হয় তবে ভোট না দেয়াও আপনার গনতান্ত্রিক অধিকার । ( আপনার এই গণতান্ত্রিক অধিকার , ব্যালট পেপারে "না ভোট" ঘরটিকে কিন্তু তুলে দেয়া হয়েছে আপনার এই অধিকারকে হরন করে । কি বলবেন ?) গণতান্ত্রিক পথে লুটপাট থেকে বাঁচার শর্টকাট রাস্তা এছাড়া আর নেই । প্রথমে যদি একটি নির্বাচনে ৩০% ভোটার উপস্থিত হয় তবে হয়তো একটি নড়বড়ে সরকার গঠিত হবে । হেরে যাওয়া দল শুরু থেকে তো তা করবেনই তারপরে না হয় দুবছরের মাথাতেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হৈচৈ জুড়ে দেবেন নতুন করে নির্বাচন দিতে । ঐ সরকার টালবাহানা করে হয়তো আরো একটি বছর থাকবেন তারপরে আভ্যন্তরীন চাপ, আন্তর্জাতিক চাপ (অর্থ সাহায্য বন্ধ, পুরানো ঋনের সুদ ফেরত, পীসকিপিং ফোর্সে লোক পাঠানো বন্ধের হুমকি ইত্যাদি) সইতে না পেরে অন্তর্বতী একটি নির্বাচন ডাকবেন । যার অর্থ ভোট এগিয়ে আসাতে আমরা দুটো বছর আগে বেঁচে গেলাম । পরবর্তী নির্বাচনে যদি আবারো একই চিত্র দেখা যায় তাহলে কি হবে ? এবার নতুন সরকার গঠনে আরো বেশী হিমশিম খেতে হবে । আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের চাপ বাড়াবেন আরো । আন্তর্জাতিক রাজনীতির রেখাচিত্র আপনার জানা থাকলে আপনি সব বুঝতে পারবেন । এখন যদি এই ডামাডোলে সামরিক সরকার এসে যায় তবে তার স্থায়ীত্বকাল কতো ?বেশী না । বর্তমান বিশ্ব রাজনীতির ধারার প্রেক্ষাপটে বুদ্ধিমান কেউ এ ঝুঁকি নেবেনা । যদি নেয় ও বেশীদিন টিকতে পারবেনা । তাকে আবার নির্বাচিত কারো না কারো হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবেই । এখানে তার আয়ুষ্কাল বড়জোড় এক বা দু’বছর । এর পূনরাবৃত্তি চলবে । তাহলে কি হতে পারে ? রাজনৈতিক সুবিধাবাদীরা তখন বুঝে যাবে হালে পানি পাওয়া যাবেনা আর । খেল খতম । দশ-পনেরো কোটি টাকা খরচ করে দেশ সেবার জন্যে তখন লোকের আকাল ঘটবে কারন একবছরে বা দুবছরের মেয়াদ কালে ঐ দশ-পনেরো কোটি টাকা সুদ সমেত তুলে নেয়ার সুযোগ নাই ।
দেশ তো আর সরকার বিহীন চলতে পারেনা দীর্ঘকাল । ভোট দিয়ে যখন আর কাজ হবেনা তখন দলের ভোটদাতারাও মাঠ ছাড়বেন । তখন বাধ্য হয়েই জনগণ, যারা ভোটদানে বিরত ছিলেন এতোদিন তারা ভালো মানুষগুলোকে টেনে এনে ক্ষমতা তুলে দেবেন, যে ভালোমানুষের জন্যে আমরা আকুল হয়ে আছি । অথবা মন্দ মানুষগুলো সব দেখেশুনে এবং ঠেকে ভালো হতে চেষ্টা করবেন । তারা আপনার আকাঙ্খা মতো দূর্নীতিমুক্ত হয়ে উঠবেন, শাপমুক্ত হবেন । একই সাথে আমরাও ।
আর এর বাইরে আরো একটি খুবই শর্টকাট আছে । য়্যু জাষ্ট হ্যাভ টু ইরেজ আ থাউজ্যান্ড পিপল সিম্পলি ফ্রম দ্য ফেস অব দ্য কান্ট্রি । কিন্তু যদি ঐশ্বরিক কিছু না ঘটে তবে এটি একটি অসম্ভব এবং একাধারে অবাস্তব পথ ।
তাই যদি আপনি গণতন্ত্রকেই চান, আপনার স্বপ্নের বাস্তবায়ন চান, তবে আমার মনে হয় যা বললাম তার বিকল্প আর কিছু নেই । এই একটি মাত্র পথ ছাড়া আমাদের নিস্কৃতি নেই কোনওকালে ।
আপনার স্বপ্ন পুরনের লক্ষ্যে, আপনার ভবিষ্যত প্রজন্মের পথচলা নিষ্কন্টক করতে “দেশ” যদি আপনার উত্তর হয় তবে এই উত্তরের “প্রশ্ন”টি আপনার জানা জরুরী ।
এখোন কি প্রশ্নটি করবেন নিজেকে ?
ভোটের লাইনে দাঁড়ানো ? নাকি, ভোট থেকে দুরে সরে থাকা অর্থাৎ সম্পূর্ণ রূপে ভোট বর্জন?
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৮ সকাল ১১:৩৪