আমরা যেখানে বসেছিলাম সেখান থেকে একটু উপরে দেয়ালের ওপাশ থেকে পাহাড়ি গাছের একটা মরা ডাল ভেঙে নিয়ে এলাম। এরপর শুরু হলো নিচের স্তরে ঝুঁকে পড়ে ডালের মাথায় আটকিয়ে টুপি তুলে আনার কসরত। কিন্তু ডালের মাথায় আঁকশি জাতীয় কিছু না থাকায় খোঁচা খেয়ে টুপি কাছে আসার পরিবর্তে দূর থেকে আরও দূরে সরে যায়। আমি যখন হতাশ হয়ে টুপি উদ্ধার অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করবো ভাবছি তখনই আমরা স্ত্রী জানলেন টুপিটা পামেলার নয় আমার। দেরি না করে তিনি সঙ্গে সঙ্গেই ঘোষণা দিলেন, ‘যেখানকার টুপি সেখানেই পড়ে থাক- তুলে না আনলেও চলবে।’
পঁচিশ ত্রিশ বছর বছর বয়সের এক সিংহলি তরুণ অনেকক্ষণ ধরে আমাদের টুপি উদ্ধার প্রয়াস লক্ষ করছিল। কথোপোকথন না বুঝলেও আমাদের উদ্ধার অভিযান যে পরিত্যক্ত হয়েছে সেটি বোঝার পরে সে এক লাফে নিচে নেমে টুপিটা তুলে হাত বাড়িয়ে আমার হাতে দিয়ে আবার সহজেই দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে এলো। আমরা তাকে ধন্যবাদ জানাবার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ভাষা নিয়ে তার নিজেরও সমস্যা ছিল। তাই আমাদের ইংরেজি ভাষার ধন্যবাদের পরিবর্তে সে শুধু মৃদু হেসে সিংহলি ভাষায় দু একটি শব্দ উচ্চারণ করেই শেষ করলো।
খোকনের টিকেট উদ্ধার অভিযান অবশ্য খুব অল্প সময়ে এবং অনায়াসেই শেষ হলো বলা যায়। প্রায় হাজার ধাপ সিঁড়ি নামা ওঠার পরেও তার মধ্যে তেমন কোনো ক্লান্তি বা শ্রান্তির চিহ্ন দেখা গেল না। এমন কি ছায়ায় দুদ- বসে একটু পানি খাবারও দরকার হলো না।
উর্ধ্বমুখি যাত্রার ঠিক মাঝপথে আমাদের সাময়িক বিরতির চত্বর থেকে বাঁ দিকে খানিকটা চড়াই পেরিয়ে ঢুকে পড়তে হবে পাহাড়ের খাঁজে আটকানো লোহার খাঁচায়। এর মধ্যে দিয়ে উঠে গেছে দুই স্তরের স্পাইরাল সিঁড়ি। যাদের এ্যাক্রোফোবিয়া বা উচ্চতা ভীতি আছে তাদের পক্ষে এই সিঁড়ি বেয়ে গুহাচিত্রের যাদুঘর পর্যন্ত পৌঁছানো কঠিন। আমাদের কারো কারো মধ্যে ভয় ভীতি কাজ করলেও কেউই তা স্বীকার করেনি। এতো কষ্টে উদ্ধার করা টিকেটের একটিও নষ্ট করা যাবে না। অতএব প্রহরীদের হাতে মূল্যবান টিকেটের মুড়ি গুঁজে দিয়ে এক এক করে আমরা সকলেই ঢুকে পড়লাম গুহাচিত্রের সংগ্রহশালায়। এক সময় পাঁচশর মতো চিত্রকর্মের অস্তিত ছিল বলে জানা গেলেও সযতেœ সংরক্ষিত বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফ্রেসকো পেইটিং-এর মাত্র গুটি কয়েক এখন টিকে আছে। পেইটিং-গুলোর মূল উপজীব্য স্বর্গের দেবী অথবা অপ্সরা। নিবেদনের ভঙ্গীমায় দাঁড়ানো নগ্নবক্ষা নারীদের ফুটিয়ে তুলতে প্রধানত ব্যবহার করা হয়েছে লাল, হলুদ এবং সবুজ রং। অপ্সরাদের হাতে পুষ্পাঞ্জলি আর নৃত্যের বিচিত্র মুদ্রা আজও শিল্পরসিকদের মুগ্ধ করে । দু একটি জায়গায় দেয়ালের পাথর খসে পড়ে চিত্রকর্মের আংশিক বিলুপ্তি ঘটেছে। এ ছাড়া দেড় হাজার বছর আগের শিল্পীদের হাতে আঁকা ছবির রং ম্লান হয়নি কোথাও।
গুহার বাইরে বেরিয়ে সামনে চলার জন্যে পশ্চিম দেয়াল ঘেষে তৈরি করা হয়েছে রেলিং দেয়া ওয়াকওয়ে। সহজ করে বললে বলা যায় পাহাড়ের পাথুরে দেয়ালে লোহার মোটা মোটা গজাল পুঁতে সেখান থেকে ইস্পাতের তার ঝুলিয়ে এবং একই সাথে নিচে থেকে ঠেকা দিয়ে তৈরি করা এই পথের পুরোটা জুড়েই বিছানো রয়েছে ধাতব পাত। মাটি থেকে তিনশ ফুট উচ্চতায় বাঁ হাতে সামান্য লোহার রেলিং ভরসা করে পাহাড়ের গায়ে গায়ে হেঁটে সামনে এগিয়ে যাবার ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে গেলে অবশ্য কারও পক্ষে গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব হতো না। তবে গায়ে কাঁটা দেবার মতো নিরাবলম্ব উচ্চতা এবং কোথাও কোথাও নড়বড়ে রেলিং-এ কিছুটা দুর্বলতা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে স্বাভাবিক চলাচলে নিচে পড়ে যাবার কোনো আশঙ্কা নেই। প্রায় শ চারেক ফুটের এই ভীতি জাগানিয়া পথ পাড়ি দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার মতো এক বিস্তৃত চত্বরে এসে পৌঁছালাম। এখানে সিংহের জোড়া পায়ের মাঝ বরাবর উঠে যাওয়া সিঁড়িতে একই সাথে বয়ে চলেছে জনস্রোতের ওঠানামা।
সিংহের দুটি প্রকা- প্রসারিত থাবার মাঝখান দিয়ে উঠে যাওয়া পাথরের সিঁড়ির দুপাশেই রয়েছে মজবুত ইটের খাড়া দেয়াল। পাথরের সিঁড়ি যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকেই শুরু হয়েছে চারস্তরের আধুনিক ধাতব সিঁড়ি। অনুমান করতে কষ্ট হয় না, দেয়ালের উপরের প্রান্তে পাহাড়ের গায়ে হয়তো কোনো এক সময় সিংহের পূর্ণাঙ্গ প্রস্তর মূর্তির অস্তিত্ব ছিল। সিংহ দুয়ার পেরিয়ে আরও কয়েক শ ধাপ আরোহণের পরেই কেবল পৌঁছানো সম্ভব হতো পাহাড়ের চূড়ায়। কালের বিবর্তনে কেশর দোলানো সিংহের মাথার সাথে ঊর্ধলোকে যাত্রার সিঁড়িও উধাও। ফলে বিকল্প ব্যবস্থা লোহার রেলিং দেয়া ধাতব সিঁড়ি। এই জনস্রোতে দেশি বিদেশি পর্যটক এবং স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং পূণ্যার্থী নারী পুরুষের সংখ্যাও নেয়ায়েত কম নয়। ধাতব সিঁড়ি বা লোহার মইÑ যাই বলা হোক, নিচে লক্ষ করলেই দেখা যায় প্রথম এবং তৃতীয় স্তর দুটি যেমন খাড়া তেমনি দীর্ঘ। দ্বিতীয় স্তরটি খাড়া হলেও এর দৈর্ঘ্য খুব বেশি নয়। চতুর্থ বা শেষ স্তরটি আসলে পাহাড়ের এবড়ো থেবড়ো পথে চলাচলের সুবিধার জন্যে তৈরি হয়েছে। এই পথের দৈর্ঘ্য একটু বেশি হলেও চলার পথ প্রায় পাহাড়ি পায়ে চলার পথের সমান্তরাল। এখানে সিঁড়িগুলো দুভাগে বিভক্ত। বাঁ পাশ দিয়ে উর্ধমুখি জনতার প্রবাহ উপরে উঠে যাচ্ছে আর নেমে আসছে ডান পাশ দিয়ে।
স্বস্তিকর চত্বর থেকে উপরের দিকে বার দুয়েক তাকিয়ে পামেলা জানালোÑ এই খাড়া সিঁড়ি বেয়ে তার পক্ষে উপরে ওঠা সম্ভব নয়। খোকন এবং মাহবুবা ততোক্ষণে সিংহের প্রসারিত থাবার ভেতরে ঢুকে গেছে। খোকনের স্ত্রী দীপুও যাত্রা শুরু করেছে তাদের ঠিক পেছনে। দেখা গেল শুধু পামেলা নয়, পর্যটকদের আরও অনেকেই ইটের স্তুপে অথবা পাথর খ-ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পড়েছেন। তাদের অনেকেই এ পর্যন্ত উঠেই অভিযানে ক্ষান্ত দিয়েছেন। চত্বরের চারিদিকের অনেকটা অংশ দেয়াল অথবা দেয়ালের ভগ্নাংশ দিয়ে ঘেরা। এখানে গাছপালা থাকায় বসে বিশ্রাম নেয়া এবং উপরে উঠে যাওয়া সঙ্গী সাথীদের নিচে নামার জন্যে অপেক্ষায় করা যায়। গাছে গাছে শাখামৃগদের লম্ফঝম্প দেখেও ভালই সময় কাটে। তবে একটু সতর্ক না হলে বানরেরা হাত থেকে বিস্কিট বা চিপসের প্যাকেট এমন কি পানির বোতল নিয়েও পালাতে পারে।
শেষের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং অংশে আরোহণের জন্যে নিঃসন্দেহে অনেক বেশি শক্তি, সতর্কতা এবং মনোবল থাকা প্রয়োজন। তারপরেও অর্ধেকেরও বেশি পথ অতিক্রম করে শেষপর্যন্ত শীর্ষে না পৌঁছে ফিরে যাওয়াটা মেনে নেয়া যায় না। অতএব দলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য আমার কন্যা আনিকাসহ উঠতে শুরু করলাম। আমাদের খানিকটা আগে যাত্রা শুরু করেছিল অমিত। দেয়াল দিয়ে ঘেরা পাথরের সিঁড়ি ভেঙে উঠতে কারো কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু লোহার সিঁড়িতে পা দিয়ে খানিক দূর উঠেই বোঝা গেল অমিতের পায়ের তুলনায় সিঁড়ির ধাপগুলো যথেষ্ট প্রশস্ত নয়। পায়ের লম্বা পাতা ফেলে প্রতি মুহূর্তে আকস্মিক পতনের শঙ্কা নিয়ে আরোহণের চেয়ে নিচে নেমে যাওয়াই ভাল। ফলে ধাতব সিঁড়ির প্রথম স্তরের মাঝ বরাবর উঠেই অমিত নেমে গেল। আমার ঠিক সামনে বাঁ হাতে রেলিং আঁকড়ে ধরে খুব সাবধানে উপরে উঠছিল আনিকা। দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রায় শেষপ্রান্তে উঠে সেও মত বদলে ফেললো। ‘বাবা, আমি আর উঠতে পারব না, এখান থেকেই নেমে যাব।’
দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পর্যায়ের অপরিসর সংযোগ স্থলে আমার কন্যা যখন নিচে নেমে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন তৃতীয় স্তরের সবচেয়ে খাড়া সিঁড়ির মাঝখানে তার চোখ পড়লো। সাদা শাড়ি পরা এক বৃদ্ধা রেলিং ধরে উপর থেকে নিচে নেমে আসছেন। তাঁর মাথার চুলগুলো সব সাদা, বয়সের ভারে সামনের দিকে একটু ঝুঁকে পড়েছেন কিন্তু টুকটুক করে একই তালে তাঁর নামার গতি দেখলেই বোঝা যায় নির্ভয়ে নিশঙ্ক চিত্তে তিনি অতিক্রম করে চলেছেন একের পর এক ধাপ। আনিকা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললো, ‘এই আশি বছরের বৃদ্ধা যদি চূড়ায় পৌঁছে আবার ঠিকঠাক নেমে আসতে পারেন, আমার জন্যে উপরে উঠতে না পারাটা খুবই লজ্জার ব্যাপার হবে। বাবা! আমি পারবো।’ আমরা দুজন তৃতীয় পর্যায়ের সিঁড়ি বেয়ে আবার উঠতে শুরু করলাম।
তৃতীয় স্তর অতিক্রম করার পরে মনে হয়েছিল বাকি পথটুকু এগোনো সহজসাধ্য হবে । কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, এ পথের রেলিং নড়বড়ে এবং পথে বিছানো ধাতব পাতগুলোও কোথাও পিচ্ছিল আবার কোথাও জায়গা থেকে একটু সরে গেছে। যথেষ্ট সতর্কতার সাথে এই পথ পাড়ি দেয়ার পরেই আবার ইট পাথরের খাড়া সিঁড়ি। বাবা এবং মেয়ে আমরা দুজনেই এই শেষের ধাপগুলো দ্রুত টপকে উঠে গেলাম পাহাড় দুর্গের শীর্ষে। চূড়ায় পৌঁছে আবারও লক্ষ করলাম পাহাড়পুর কিংবা ময়নামতি বৌদ্ধ বিহারের প্রতœতাত্ত্বিক চেহারার সাথে এর আশ্চর্য মিল! পাহাড়ের মাথায় বিভিন্ন স্তরে ইটের চওড়া দেয়াল দিয়ে নির্মিত অসংখ্য ছোট বড় কক্ষের নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। হয়তো মাঝখানের বিশাল ভবনটিই ছিল রাজা কশ্যপের শয়ন কক্ষ। এখান থেকে দক্ষিণ পূর্ব দিকে দুই স্তর নিচে চোখে পড়ে বিশাল দিঘি। ইটের দেয়াল দিয়ে ঘেরা শান বাধানো ঘাটসহ দিঘির পানি স্ফটিক স্বচ্ছ না হলেও এখনও যথেষ্ট পরিস্কার। রাজ পরিবারের নারীরা যে এই দিঘির জলে স্নান করতেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পাথরের সিঁড়ি দিয়ে কয়েক ধাপ নেমে দিঘির জল ছুঁয়ে আসা যেতো, কিন্তু আমাদের হাতে সময় কম, তাই সে ইচ্ছে বাদ দিতে হলো। ইট পাথরের নির্মাণ এবং দিঘি পুকুর ছাড়াও এখানে এই মনোলিথিক পাথরের সাড়ে ছয়শ ফুট উচ্চতায় লতাগুল্ম এবং ঘাসের আস্তরণের পাশাপাশি বড় বড় গাছগুলো কি করে পুষ্প পাতায় শোভিত হয়ে বেড়ে উঠেছে তাও বিস্ময় জাগায়। দেড় হাজার বছর আগে যখন এখানে উদ্যান গড়ে তোলা হয়েছিল তখনই বা কী পদ্ধতিতে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করেছিল প্রাচীন যুগের প্রকৌশলীরা!
আমাদের অনেক আগেই চূড়ায় পৌঁছে গেছে মাহবুবা, খোকন এবং দীপু। রাজা কশ্যপের কথিত বাসভবনের মাঝখানে একটি বড় আয়তকার প্রস্তরখণ্ড যে স্থানটিকে সর্বোচ্চ স্থান হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে সেখানে দাঁড়িয়ে সকলেই দুই হাত দুপাশে ছড়িয়ে ছবি তোলায় ব্যস্ত। পর্যটকদের ভিড় একটু হালকা হতেই স্ত্রী কন্যাসহ সেই পাথরে উঠে দাঁড়ালাম। খোকনের ক্যামেরায় বন্দী হয়ে গেল সিগিরিয়ার শীর্ষ জয়ের একটি মুহূর্ত।
চলবে...