আমার পাসপোর্টের পাতা উল্টেপাল্টে দেখার পরে কোনো লাভ হবে না জেনেও ইমিগ্রেশন পুলিশ একটু পুরোনো খেলা খেলতে চেষ্টা করলেন।
‘আপনার পাসপোর্টে তো কোনো ভিসা নাই!’
‘জ্বি! শ্রীলঙ্কায় যেতে ভিসা লাগে না। বাংলাদেশী পাসপোর্ট হোল্ডারদের জন্যে এখনও ভিসা অন এ্যারাইভাল চালু আছে।’
‘ওÑ তাই নাকি!’ তিনি যেনো আকাশ থেকে পড়লেন।
আমি বোধহয় একটু রূঢ়ভাবেই বললাম, ‘বিষয়টা তো আমাদের চেয়ে আপনাদেরই বেশি করে জানা থাকার কথা।’
এরপর ভদ্রলোক আর কথা না বাড়িয়ে ‘এক্সিট’ সিল দিয়ে ছেড়ে দিলেন। পরে জেনেছি একই দিন বেলা একটার ফ্লাইটে আমাদের দলের আরও অন্তত তিনজনকে নিয়ে একই খেলা খেলতে চেষ্টা করেছে ইমিগ্রেশন, তবে আগের মতোই তা ফলাফল শূন্য।
সাড়ে এগারোটায় দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে এসে নামলাম দীর্ঘ তেরো বছর পরে। ভেতরের চাকচিকের পাশাপাশি বিস্তৃতিও বেড়েছে। তবে প্রচুর যাত্রীর আসা যাওয়া থাকলেও ভারতের মতো দেশে একটি রাজধানী শহরের বিমান বন্দরে যে পরিমাণ ব্যস্ততা থাকার কথা তা চোখে পড়লো না। অবশ্য সমস্যা তৈরির ব্যাপারে ঢাকা এয়ারপোর্টের চেয়ে এরা খুব একটা পিছিয়ে নেই। প্রথম যে সমস্যায় পড়লাম, তা হলো বোর্ডিং পাস না থাকলে ট্রাঞ্জিট লাউঞ্জে ঢোকা যাবে না। জেট এয়ারের লোকটি অকারণেই আমার নাম নিবাস ইত্যাদি জিজ্ঞেস করার পরে জানতে চাইলেন, আমার ইন্ডিয়ান ভিসা আছে কিনা!
উত্তর দিলাম, ভিসা থাকলে আপনাদের মুখশ্রী দর্শন না করে এতোক্ষণে দিল্লি শহরে একটা চক্কর দিতে বেরিয়ে যেতাম।
চরম বিরক্তি নিয়ে কিছুক্ষণ কম্পিউটারে ঘাটাঘাটি করে সম্ভবত আরও নিশ্চিত হবার জন্যে তিনি তার ঊর্ধ্বতন কাউকে ফোন করলেন এবং এরপর আমার পাসপোর্ট এবং ই-টিকেটের প্রিন্টটা হাতে করে দীর্ঘ সময়ের জন্যে গায়েব হয়ে গেলেন। আমার ফ্লাইট সন্ধ্যা ছয়টায়, কাজেই উদ্বিগ্ন হবার মতো কোনো ব্যাপার তখন পর্যন্ত ঘটেনি। তাছাড়া ট্রাঞ্জিট প্যাসেঞ্জার হিসাবে যারা বিভিন্ন এয়ারপোর্টে যাতায়াত করেছেন তারা জানেন ফ্লাইট ছাড়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিটি যাত্রীকে খুঁজে বের করে বিমানে তুলে দেবার জন্য একটি ও একদল সদাব্যস্ত কর্মী সারাক্ষণ এয়াপোর্ট জুড়ে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে। কাউকে মাটিতে ফেলে রেখে কোনো বিমানই আকাশে উড়াল দিতে চায় না।
অতএব আমি জেট এয়ারের দীর্ঘ কাউন্টারের সামনে পেতে রাখা সারি সারি রঙিন চেয়ারের একটাতে বসে যাত্রীদের আসা যাওয়া দেখি আবার কখনও ঝিমাই। সিকিউরিটি চেকিং-এর লাইন কখনও দীর্ঘ হতে হতে বহুদূর চলে যায়, আবার ধীরে ধীরে লাইনের দৈর্ঘ্য কমতে থাকে। কিন্তু আমার পাসপোর্ট-টিকেট-বোর্ডিং পাস কোনোটাই আর ফিরে আসে না। প্রায় ঘণ্টা খানেক পরে ধৈর্য্যরে সীমা শেষ হয়ে যাবার পরে ফিরে এলেন জেট এয়ারের করিৎকর্মা। বোর্ডিং পাস এবং পাসপোর্ট হাতে দিয়ে বললেন, ‘নাউ ইউ ক্যান গোÑ’
নিরাপত্তা এলাকা পেরিয়ে ট্রাঞ্জিটে যাবার লাইন ততোক্ষণে আবার দীর্ঘ হয়েছে। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যখন প্রায় সিকিউরিটি চেকিং-এর দরজায় পৌঁছে গেছি তখন লাইনেই নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের একজন একজন জানতে চাইলেন, ‘কোথায় থেকে আসছেন?’
বললাম, ‘ঢাকা থেকে।’ তিনি বোর্ডিং পাস হাতে নিয়ে দেখে বললেন, ‘এখানে তো ডাইরেক্ট ট্রান্সফার লেখা নেই।’
‘এটা লেখার দায়িত্ব কি আমার?’ স্পষ্টতই আমার কণ্ঠে বিরক্তি। নিরাপত্তা কর্মকর্তা এবারে একটু বিব্রত হয়ে বললেন, ‘নো নোÑ ইঁস দেয়ার মিসটেক। প্লিজ গো টু দ্য কাউন্টার এ্যান্ড আস্ক দেম টু রাইট ইট ডাউন অন দ্য পাস।’
‘দেন ওয়ানস এগেইন আই হ্যাভ টু স্ট্যান্ড এ্যাট দ্য টেইল অব দ্য লাইন?’
তিনি অবশ্য লাইন ভেঙে সরাসরি তার কাছে চলে আসতে বললেন এবং আসার সহজ পথটাও দেখিয়ে দিলেন। এবার কাউন্টারে সেই করিৎকর্মাকে পাওয়া গেল না। তার পরিবর্তে একজন মধ্য বয়সী ভদ্র মহিলা মৃদু দুঃখ প্রকাশ করে বোর্ডিং পাসের উপরে কলম দিয়ে লিখলেন, ‘ডি-টি’।
বিশাল ট্রাঞ্জিট এলাকায় ঢুকে পড়ার পরে ফ্লাইটের অপেক্ষা করা ছাড়া তেমন কোনো কাজ নেই। অতএব একটা লম্বা সোফায় হাত পা ছড়িয়ে আইপ্যাড খুলে বসলাম। দুনিয়ার সব এয়ারপোর্টই এখন ফ্রি ওয়াইফাই জোন। আরও দু বছর আগে কুয়ালালামপুর এবং হ্যানয় এয়ারপোর্টে চমৎকার ইন্টারনেট কানেকশানের অভিজ্ঞতা হয়েছে। কিন্তু এখানে আইপ্যাডে সংযোগ পাবার চেষ্টা করে দেখা গেল তারা একটি মোবাইল নম্বর চায়। সেই মোবাইলে পাঠানো পাসওয়ার্ড দিয়ে চালু করতে হবে ইন্টারনেট সংযোগ। এ জন্যে একটি ভারতীয় মোবাইল নম্বর অথবা রোমিং নম্বর প্রয়োজন। আমার যেহেতু কেনোটাই নাই, সেক্ষেত্রে অন্তর্জাল যোগাযোগের চেষ্টা করা বৃথা। আইপ্যাডটা আবার ব্যাগে ভরে উঠে পড়লাম।
দিল্লি বিমান বন্দরের ভেতরে যে স্থাপনাটি সহজে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হলো ব্রোঞ্জের তৈরি বিশাল বুদ্ধমূর্তি। অবশ্য বুদ্ধমূর্তি না বলে এটাকে গৌতম বুদ্ধের মুখ ম-লের প্রতিকৃতি বলাই ভালো। স্কালপচারটা ভালো লেগে যাওয়ায় চারপাশে ঘুরে বেশ কয়েকটা ছবি তুললাম। তখনো জানতাম না আমার এই ভালোলাগার সূত্র ধরে পুরো শ্রীলঙ্কা জুড়ে শুয়ে বসে দাঁড়িয়ে মহামতি বুদ্ধ আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছেন!
ঘুরতে ঘুরতে এক সময় চলমান সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে সাইবার ক্যাফে জাতীয় একটি ছোট্ট টংঘর আবিস্কার করলাম। একটা গোল টেবিলকে ঘিরে সাকুল্যে চারটি কম্পিউটার নিয়ে ইন্দিরা গান্ধী ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে ভোডাফোনের ফ্রি ইন্টারনেট সেবা। ‘সাইবার ক্যাফের’ গোল ঘরের চারপাশে একবার চক্কর দিয়ে দেখা গেল মহারাষ্ট্রের কোনো একটি স্কুলের একদল ছাত্রী চারটি কম্পিউটার দখল করে বসে আছে। সম্ভবত দল বেধে কোথাও ‘শিক্ষা সফরে’ বেরিয়েছে তারা। প্রত্যেকের স্ক্রিনে ফেসবুকের পাতা খোলা। এক একটি পেইজে একটি মন্তব্য লিখে এন্টার চেপেই হেসে গড়িয়ে পড়ছে তারা। বুঝলাম এদের ফ্লাইটের লাস্টকল না আসা পর্যন্ত টেবিল খালি হবার কোনো সম্ভবনা নেই।
ভোডাফোনের টংঘর বাদ দিলে পুরো দোতলা জুড়েই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের নানা স্বাদ-বর্ণ-গন্ধের বিচিত্র খাবারের সারি সারি দোকানের পসরা সাজানো। ইডলি সম্বার ছাড়া প্রায় সব ধরণের দক্ষিণ ভারতীয় খাবার আমার পছন্দ। ক্রাঞ্চি কিচেন নামের একটি সাউথ ইন্ডিয়ান দোকানের মধ্যে মেন্যু দেখে ওনিয়ন উত্থাপা এবং কোল্ড ড্রিংস নিয়ে টেবিলে এসে বসলাম। একটু পরেই গোটা কয়েক কবুতর এসে পায়ের কাছে ঘোরাঘুরি শুরু করলো। উত্থাপা ভেঙে দু একটা টুকরা ছুঁড়ে দিয়ে বোঝা গেল দক্ষিণ ভারতের খাবার উত্তর ভারতের কবুতরদেরও বেশ পছন্দ।
সাউথ ইন্ডিয়ান লাঞ্চ শেষ করে আমি যখন ইন্টারনেটের টংঘরে ফিরে এলাম ততোক্ষণে মহারাষ্ট্রের কৃতি ছাত্রীরা সদলবলে উধাও। কিন্তু চারটি কম্পিউটারই বিভিন্নজনের দখলে। নিচে উপরে ঘোরাঘুরি করে আরও আধা ঘণ্টা পরে যখন ফিরে এসে দাঁড়াতেই একটি কিশোর নিজে থেকে বলে উঠলো, ‘আঙ্কেল ইউ ক্যান ইউজ দিস।’ তাকে ধন্যবাদ দিয়ে টেবিলে বসলাম কিন্তু বার কয়েক চেষ্টা করেও কানেক্ট করতে পারলাম না। ছেলেটি তখন পাশের টেবিলে তার বড় বোনের পেছনে দাঁড়িয়ে তাকে নানা রকম নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে। অগত্যা আবার তার শরণাপন্ন হতে হলো। সে এসে মুহূর্তেই সংযোগ দিয়ে শিখিয়েও দিয়ে গেল কি করে লগআউট করতে হবে এবং প্রয়োজনে আবার কি করে আবার লগইন করা যাবে। ছেলেটির সাথে কথা বলে জানা গেল ওরা লখনৌতে থাকে। আসিফ আলি স্কুলের ক্লাস এইটে পড়ে আর তার বড় বোন ফারজানা আলি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। লখনৌ-এর আদব কায়দার অনেক গল্প শুনেছিলাম এবারে নিজেই সেসব কাহিনির অন্তত একটা প্রমাণ পেলাম।
তবে ভোডাফোনের টংঘর থেকে এতো কাঠখড় পুড়িয়ে মেইল পাঠালেও কলম্বো যাত্রীরা সে মেইল পড়তে পেরেছিলেন শ্রীলঙ্কা পৌঁছাবার পরদিন। কারণ দিল্লির মতো মুম্বইয়ের ইন্টারনেট সেবাও এয়ারপোর্ট জুড়ে ফ্রি ওয়াইফাই যুগে প্রবেশ করেনি। আমার ঘণ্টা খানেক সময় অবশ্য আসিফ আলির সৌজন্যে সংযুক্ত ইন্টারনেটে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘেটে ভালোই কেটে গেল। যখন আরেকজন যাত্রীর হাতে কম্পিউটার ছেড়ে দিয়ে ডিজিটাল টংঘর থেকে বেরিয়ে এলাম তখন আমার বিমানে উঠবার ডাক এসে গেছে।
টিপস্: ১.শ্রীলঙ্কা যাবার জন্যে ভিসার প্রয়োজন নেই। পাসপোর্টের মেয়াদ অন্তত ছয় মাস থাকতে হবে।
২. ভিসা ফি কলম্বো এয়ারপোর্টে ২০ ডলার মাত্র।
৩. বর্তমানে জেট এয়ারের ঢাকা- বোম্বো-কলম্বো অথবা ঢাকা-দিল্লি-কলম্বো ফ্লাইট স্থগিত করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে মিহিন লঙ্কা ফ্লাইটে সরাসরি অথবা কম খরচে যাবার জন্যে ব্যাংকক হয়ে ব্যাংকক-কলম্বো অংশ এয়ার এশিয়ায় যাওয়া যেতে পারে।
পরবর্তী পর্ব: আগামী সপ্তাহে
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ৮:৩৮