somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রাজশাহীতে এখনো সংরক্ষিত আছে অত্যাচারী দেওরাজের নরবলী দেয়ার যন্ত্র , সেই যুপকাষ্ঠ (ছবিব্লগ)

২৫ শে জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১১:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলাদেশের অন্য যেকোনো জেলার ইতিহাসের চেয়ে রাজশাহী শহরের পত্তনের ইতিহাস আমাকে বেশি আকর্ষন করে। সেটা হতে পারে ছোটবেলা থেকে এই গল্পগুলো শুনে শুনে বড় হয়েছি তাই। কিন্তু গল্পের সেই মহাকাল গড় রাজ্য, দেওরাজের শাসন-শোষন, কালো জাদুর চর্চা, নরবলী..মানে শোষনের চরম পর্যায়ে চলে যাওয়া একটা জনপদ বলতে যা বোঝায়, তার সমস্ত উপাদানই ছিলো সেই রাজ্যে। সেখান থেকে ক্রমশ উত্তোরন, যুদ্ধ, নতুন রাজ্যের পত্তন..পুরোটাই যেনো টানটান একটা থ্রিলার উপন্যাস, পাতায় পাতায় ক্লাইম্যাক্সে ঠাসা।

তখনকার সময়ে ফসল আর মাছ ছিলো অর্থনীতির মূল ভিত্তি, তাই সব শাসকদের মেইন ফোকাস থাকতো জেলে আর কৃষক উৎপাদন কাজের সাথে জড়িত নিম্নবরণের প্রজাদেরকে কিভাবে হাতের মধ্যে রাখা যায়। তার জন্যে বিভিন্ন শাসক অনুসরন করতো বিভিন্ন রকম পদ্ধতি। দেওরাজের পদ্ধতিটা ছিলো এরকম, সে প্রতি বছর পূজার সময়ে একজন মানুষকে দেবতার উদ্দেশ্যে বলী দিতো। সেই পূজা কোন সময় হবে বা কি ধরণের বলী দেয়া হবে সেটা নির্ধারন করা হতো গণনার মাধ্যমে।

ধর্মের নামে কতকিছুই তো জায়েজ করা হয় এযুগেও। তখন সেটা হতো আরো ব্যপকভাবে। তাই এভাবে ভালোই চলছিলো সবকিছু। প্রজারাও তা মেনে নিয়েছিলো, পুজা-পার্বন তো আর প্রতিদিন হয় না, আর একটা মাত্র মানুষই তো মরবে। তাই প্রতিবার পূজার ঘোষনা কানে যেতেই শিউরে উঠতো প্রতিটি প্রজার অন্তরাত্না। ঢেরা পিটিয়ে শুরু হতো বলীর উপযুক্ত নরের অন্বেষন। তারপর তাদের মধ্যে থেকে একজনকে মনোনীত করা হতো। এই প্রক্রিয়াটা শেষ হওয়ার সাথে সাথে হাঁপ ছেড়ে বাচতো সবাই। কে জানে হয়তো নাম ঘোষনার সাথে সাথেই মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করতো অনেকে। যাক আপদ বিদায় হলো, আরো কিছুদিন সবাই মিলে নিরাপদে থাকা যাবে। শুধু কান্নার রোল উঠতো একটা পরিবারে...

এর মধ্যেই একটা ঘটনা ঘটলো। সেসময় এর তাৎপর্য হয়তো কেউ সেভাবে বুঝে উঠতে পারেনি, কিন্তু এখন আমরা বুঝি এই সামান্য ঘটনা কতটা সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন এনেছিলো এই জনপদে। একবার পূজার আগে বলীর জন্য সাব্যস্ত হলো নাপিত পরিবারের এক ছেলের নাম। তাকে বলী দেয়া হলো সেইবার। এরপর যখন আবার পুজার ক্ষণ এলো, দেখা গেলো এবারও গণনায় তোলা হয়েছে সেই একই ঘরের মেজো ছেলেকে। সেবার সেই পরিবারের প্রতিক্রিয়া কি ছিলো বা তারা প্রতিবাদ করেছিলো কিনা জানা তা আমাদের জানা নেই, তবে এটা জানা আছে যে সে বছরেও কোনো বিঘ্ন ছাড়াই সুসম্পন্ন হয়েছিলো পূজা ও নরবলী। এভাবেই চলে আসলো পরবর্তী পুজার ক্ষণ। আমাদের সম্ভাব্যতার অংক কি বলে? সেই পরিবারের কারো আবার বলীর শিকার হওয়ার সম্ভাব্যতা কি খুব বেশী? না। কিন্তু পরের বছর দেখা গেলো এবারও বলীর উপযুক্ত হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছে সেই একই নাপিত বাড়ীর তিন ছেলের মধ্যে সবচেয়ে ছোট এবং তাদের শেষ সন্তানটি কে।

পরপর দুই ছেলেকে বলীর যুপকাষ্ঠে তুলে দেয়ার পর শেষ সন্তানকে বলীর জন্য সাব্যস্ত হতে দেখে পিতার মনের ভেতর জ্বলে ওঠে বিক্ষোভের ছাই চাপা আগুন। বলী দেয়ার দিন যতই সামনে আসতে থাকে, সে ছটফট করতে থাকে যদি কোনো ভাবে এই ছেলেটিকে পিশাচ রাজার হাত থেকে বাঁচানো যায়। কিন্তু একজন প্রবল প্রতাপশালী শাসকের বিরুদ্ধে সামান্য এক দরিদ্র নাপিত কিই বা করতে পারে?

সে জানতো ততদিনে দিল্লীতে মোঘল শাসনের পত্তন হয়েছে, আরবের কন্টকাকীর্ণ শুষ্ক জমি পেরিয়ে মুসলিম শাসকরা ক্রমে এগিয়ে আসছে ভারতের উর্বর মাটির দিকে। হিন্দু রাজারা তা নিয়ে বিলক্ষণ দুঃচিন্তায় ছিলো। একমাত্র মুসলিম বাহিনীকে যদি কোনোভাবে এই দেওরাজের ভূমিতে আনা যায়, বলী অনুষ্ঠানের আগেই, একমাত্র তাহলেই হয়তো বাঁচানো যাবে তার শেষ সন্তানকে। এই আশার ক্ষীণ আলো জ্বালিয়ে রাখতেই অতি গোপনে সে যোগাযোগ স্থাপন করতে পেরেছিলো এক মুসলিম সাধকের সাথে। তার কানে গিয়েছিলো , এই সাধক অত্যন্ত দয়ালু মানুষ। তার কাছে যদি এই অত্যাচারের কাহিনীটা সে খুলে বলতে পারে, তাহলে তিনি নিশ্চই কোনো মুসলিম রাজার দরবারে তা পৌছে দিবেন।

এই ভেবেই যোগাযোগ করে সে কোনো ভাবে পৌছে গেলো মুখঢাকা সেই সাধকের দরবারে, তুরকান শাহ হত্যাকান্ডের পর মুসলিম শাসকদের নজর কেন্দ্রীভূত হয়েছে মহাকাল গড়ের দিকে। সেখানকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের বিশেষ দায়িত্ব নিয়েই বর্তমান বাঘা উপজেলায় আস্তানা গেড়েছিলেন ছদ্মবেশী সেই মুসলিম সাধক। নাপিতের সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বললেন তিনি। ঠিক হলো সন্ধ্যায় পদ্মার তীরে আসবেন তিনি, সেখানেই বিস্তারিত কথা বলবেন সেই নাপিতের সাথে। এরপর যা করার তা করা হবে।

কথা বলে নাপিত কিছুটা আশস্ত হয়ে ফিরে আসলেন সেই দরবার থেকে, তবুও মনের ভেতর দুঃচিন্তার মেঘ। কারণ ঠিক পরের দিন সকালেই যে বলীর অনুষ্ঠান!

সেদিন বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই এক নিঃসহায় পরিবারকে দেখা গেলো উদ্ভ্রান্ত চেহারায় পদ্মার তীরে দাঁড়িয়ে থাকতে। কখন সেই সাধক আসবেন, উদ্ধার করে নিয়ে যাবেন তাদেরকে। ক্ষণে ক্ষণে চকচক করে উঠে নাপিত পিতার চোখ, আবার পরক্ষণেই চেহারা মিইয়ে যায় দুঃচিন্তায়। কিন্তু অপেক্ষা করতে করতে অনেক রাত তো হলো, কোথায় সেই সাধক?

অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর নাপিত বুঝতে পারলো আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকা বৃথা। কেউ আসবে না তাদেরকে বাঁচাতে। যা করার নিজেকেই করতে হবে। হয় পুরো পরিবার নিয়ে পালিয়ে যেতে হবে, ধরা পড়লে সপরিবারে মরতে হবে, আর নাহলে নিজেরাই নিজেদেরকে শেষ করে দিতে হবে। অন্তত আর কোনো ছেলেকে বলীর যন্ত্রে তুলে দেয়ার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়।

হতাশ, নিরুপায়, বিব্রত সেই নাপিত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে দাড়ালো। মনস্থিত করলো সপরিবারে পদ্মার নদীতে ঝাপ দেবে তারা। স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে ক্রমশ এগিয়ে যেতে লাগলো উত্তাল পদ্মার স্রোতের অভিমুখে।

কোমর থেকে গলা পানি পর্যন্ত এগিয়েছে তারা, ঠিক এমন সময় সে সামনে থেকে একটা ডাক শুনতে পেলো। “ভয় নাই! ভয় নাই!” হঠাৎ ডাক শুনে চমকে উঠে ঝট করে সামনে তাকালো লোকটি।

আজকের মতো কাহিনীটা এই পর্যন্তই থাকুক। কালের আবর্তনে প্রবল প্রতাপশালী সেই দেওরাজের পতন হয়েছে, মহাকাল গড়ের বিধ্বস্ত রাজ্যের উপর পত্তন হয়েছে রাজশাহী শহরের। তবে ইতিহাস অনেক কিছুই মনে রাখেনি, আমরা বিস্মৃত হয়েছি সেই পরিবর্তনের ঝান্ডা তুলে ধরা সেই নাপিতের নামধাম পরিচয়। (এই নাপিতের কথা মোটমাট দুইবার এসেছে ইতিহাসে, তবে কোথাও তার নাম পরিচয় পাওয়া যায়নি, ১৮৩৮ সালে লেখা এক দলিলে বলা হয়েছে তার উত্তরপুরুষরা এই নরসুন্দর পেশার সাথেই যুক্ত ছিলো এবং সেই আস্তানাটি নাপিতদের এলাকা হিসেবে চিনহিত ছিলো তখনো) কিন্তু সব কিছু হারিয়ে গেলেও কালের সাক্ষী হিসেবে থেকে গেছে দেওরাজের নরবলী দেয়ার সেই যুপকাষ্ঠটি। যদিও এর আরও অনেক কলকব্জা ছিলো, তবে মূল ফ্রেমটা বর্তমানে সংরক্ষণ করা হয়েছে সেই মুসলিম সাধক, শাহ মখদুম (রহ) এর মাজারে।





মাজারের সাথে সংশ্লিষ্টদের মুখে যা শুনলাম, তাদের ভাষায়, যখন সব যন্ত্রপাতী সহকারে একটা মানুষকে এখানে বাঁধা হতো তার একটা পেশী নাড়ানোর ক্ষমতাও থাকতো না।

(শেষকথা: যুপকাষ্ঠের বলী হয়েছিলেন রাজশাহীতে ইসলাম প্রচারে আসা প্রথম দলটি। তার প্রেক্ষিতে এখানে প্রেরন করা হয় তুরকান শাহ রহ কে। সেইবার বলী দিতে ব্যর্থ হলেও তাকে সদলবলে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছিলো দেওরাজার বাহিনী। তবে আপাতত সেদিকে যাচ্ছি না, সেটা আবার আরেক লম্বা কাহিনী।)

সংশোধনীঃ
এই কাহিনীটা লেখার সূত্রেই এ সংক্রান্ত তথ্যনির্ভর একটা বই হাতে পেলাম। তাই পুরো পোস্টটা আবার রিভিশন দিতে হলো। সেখানে একটা ব্যাপার ভুল হয়েছিলো, সেটা হলো, বলী দেয়া হয়েছিলো এক নাপিত পরিবারের দুই ছেলেকে, জেলে পরিবার না। তবে মূল কাহিনীটা ঠিক সেভাবেই উল্লেখ আছে মূল দলিলে। আরও কিছু তথ্যসহ পোস্ট আপডেট করে দিলাম। যারা গতকাল রাতে পড়েছিলেন তাদেরকে অনুরোধ করছি আর একবার এই পোস্টটা পড়ার জন্য :)

--
আরও পড়ুনঃ
মুসলিম বিশ্বে ব্লাসফেমি: ধর্মের মুখোমুখি প্রগতি ও বাকস্বাধীনতা?

আরাদিয়া, মধ্যযুগের ডাইনীরা ও তাদের ধর্মবিশ্বাস
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১২:১২
২১টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×