জল বিদ্যুৎ প্রকল্প কি Global Warming এর কারণ হতে পারে ?
এতকাল নদীতে বাঁধ দিয়ে সৃষ্ট জলবিদ্যুত প্রকল্পের সপক্ষে অন্যতম যুক্তি ছিল, বৈশ্বয়িক উষ্ণতা (Global Warming) বৃদ্ধিতে এ ধরণের প্রকল্পের বিরূপ প্রভাব নেই। অর্থাৎ , এ ধরনের জলবিদ্যুত প্রকল্পগুলো কার্বন-ডাই-অক্সাইড বা মিথেনের মত গ্রীনহাউস গ্যাস সৃষ্টি করে না, যেমনটি সৃষ্টি হয় ফসিল জ্বালানী ব্যবহার করে বিদ্যুত উৎপাদনের সময়।
কিন্তু , সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষনায় দেখা গিয়েছে যে , জলবিদ্যুত উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রবাহমান নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে সৃষ্ট জলাধার হতে উল্লেখ যোগ্য পরিমানের কাবর্ন-ডাই-অক্সাইড ও মিথেন গ্যাস প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। নির্গত কার্বনের পরিমান বাঁধ সৃষ্ট জলাধারের আকার-আকৃতি , স্থানীয় ভূপ্রকৃতি-জলবায়ু -তাপমাত্র এবং উদ্ভিত জগতের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে। কোন কোন ক্ষেত্র এ ধরনের গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমনের হার ফসিল জ্বালানী (কয়রা, তেল বা প্রকৃতিক গ্যাস) ব্যবহার করে সৃষ্ট বিদ্যুত থেকেও বেশি।
Mitigation and Adaptation Strategies for Global Change এর ১৯৯০ এর এক গবেষনা রিপোর্টে দেখা যায যে , ব্রাজিলের Pará অবস্থিত Curuá-Una dam জলবিদ্যুত প্রকল্প থেকে সৃষ্ট গ্র্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণ তেল জ্বালানী ব্যবহারকারী সম পরিমাণ বিদ্যুত উৎপাদনক্ষম বিদ্যুত কেন্দ্র হতে সাড়ে তিনগুন বেশি।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে World Commission on Dams নামক সংগঠনের এক রিপোর্টে আরও বিস্তারিত উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়েছে। মাত্র ১১২ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পূর্ণ ব্রাজিলের Balbin জল বিদ্যুত প্রকল্পের প্রথম বিশ বছরের প্রতি বছর নিঃসরিত কার্বনের পরিমাণ ৩ মিলিয়ন টন আর ফরাসি গায়েনার Petit-Saut এর একই ক্ষমতার জল বিদ্যুত প্রকল্পের তা ০•৯ মিলিয়ন টন। অপর দিকে , একই ক্ষমতার একটি কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুত কেন্দ্র হতে নিঃসরিত কার্বনের পরিমান প্রতি বছর ০•৩৫ মিলিয়ন টন।
South Asian Network on Dams, Rivers and People (SANDRP) এর হিমাংশু ঠাকুর তার এক গবেষনায় দেখিয়েছেন, ভারতের ৭৪ টি জলবিদ্যুত প্রকল্পের জলাধার থেকে নির্গত মিথেন গ্যাসের পরিমাণ সমগ্র ভারতের বার্ষিক মিথেন গ্যাস নির্গমনের ১৮•৭০%।
জল বিদ্যুত প্রকল্পের সাথে গ্রীনহাউজ নিঃসরণের সম্পর্ক কি ?
জল বিদ্যুত প্রকল্পের জন্য বাঁধ নির্মাণের পর প্রথম যখন জলাধারটি পানি দ্বারা পূর্ণ করা হয়, তখন নিমজ্জিত এলাকার বিপুল পরিমানের গাছ-লতা-পাতা জল মগ্ন হয়ে বা পািনর নিচে তলিয়ে গিয়ে মরে পঁচে ধবংস হয়। উদ্ভিদরাজি পচন প্রক্রিয়ায় বিপুল পরিমাণে কার্বন - ডাই- অক্সাইড বায়ুতে যুক্ত হয়। অর্ধপচনকৃত উদি্ভদরাজি জলাআধারে নিচে সঞ্চিত হয় এবং সেখানে অক্সিজেনের অবর্তমানের পচন প্রক্রিয়া চলতে থাকায় , তা থেকে মিথেন গ্যাস নির্গত হয় । এ ই মিথেন অংশতঃ জলাধারের পানিতে দ্রবীভূত হয়ে বিশাল এলাকার জল জীব জগত কে ধবংস করে দেয়। আর বাকি মিথেন জলাধারের তলদেশ থেকে বেরিয়ে এসে বায়ু মন্ডলে যুক্ত হয়। আর বদ্ধ জলাধার হচ্ছে মিথেন উৎপাদনের উৎকৃষ্ঠ ক্ষেত্র।
এই গ্রীন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ শুধু জল বিদ্যুত প্রকল্পের সূচনা লগ্নে ঘটে না। প্রতি বছর বিভিন্ন মৌসুমে জলাধারের পানির উচ্চতা পরিবর্তনের সাথে সাথে নতুন পচনশীল উপাদান যুক্ত হতে থাকে। শুষ্ক মৌসুমে যখন জলাধারের পানির স্তর নিচে নেমে আসে , তখন জলাধারে দুই পাশে নানা জাতের লতা-গুল্ম জন্মে। আর বর্ষা মৌসুমে এই লতা গুল্ম যখন আবার তলিয়ে যায় তখন পচন প্রক্রিয়ার নতুন মিথেন তৈরি হয়। উল্লেখ্য গ্রীনহাউজ গ্যাস হিসাবে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের চেয়ে মিথেন ২০ গুন শক্তিশালী।
টিপাইমুখ বাঁধ বাড়াবে গ্রীন হাউজ গ্যাস নিঃসরণঃ
World Commission on Dams এর পূর্বে উল্লেখিত রিপোর্ট টিতে বলা হয়েছে, জল বিদ্যুত প্রকল্পের জন্য নির্মিত বিশাল এলাকাব্যাপী জলাধার থেকে মিথেনের মত গ্রীনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের হার গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের জন্য উল্লেখ যোগ্যভাবেই বেশি।
Greenhouse gases are emitted for decades from all dam reservoirs in the boreal and tropical regions for which measurements have been made. This is in contrast to the widespread assumption that such emissions are zero............................. There is no justification for claiming that hydroelectricity does not contribute significantly to global warming."
উপরের চিত্রে প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ সংলগ্ন এলাকা দেখা যাচ্ছে। নদীর দুই পাড়ে মাথা উচু করে থাকা পাহাড়ের বুকের সবুজ বৃক্ষরাজির অনেকাংশ তলিয়ে যাবে জলাধারের পানির নিচে । তলিযে যাবে নদী উপত্যাকার বনভুমি- ফসলি জমি- ফল বাগান। আর এ সব জৈব্য বস্তুর পচন প্রক্রিয়ায় তৈরি হবে বিপুল পরিমাণ মিথেন গ্যাস।
মনে রাখা ভাল টিপাইমুখ বাঁধ তৈরি হচ্ছে গ্রীষ্ম মন্ডলীয় অঞ্চলে । আর যেখানে রয়েছে পাহাড়ের বুকে সুনিবিড় গ্রীষ্ম মন্ডলীয় বনভূমি। এই বনভূমির ঝরা পাতা-মরা গাছ পালা অসংখ্য ছোট ছোট ঝরনা আর জলধারা মাধ্যমে ‘বারক’ আর ‘ টুভাই‘ এর বুক বেয়ে থমকে দাড়াবে জলাধারের নিচে এবং সেখানে চলবে অনুকুল তাপমাত্রায় বিরামহীন মিথেন তৈরির প্রক্রিয়া। টিপাই মুখ জল বিদ্যুত প্রকল্প বৈশ্বয়িক উষ্ণতা (Global Warming ) বৃদ্ধিতে যোগ করবে নতুন মাত্রা।
ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত কোন জল বিদ্যুত প্রকল্প যদি টিপাইমুখ জল বিদ্যুত প্রকল্পের সম পরিমাণ গ্রীনহাউজ গ্যাস উৎপাদন হয়, তবে Global Warming প্রক্রিয়ায় দুই টি কারণে টিপাইমুখ জল বিদ্যুত প্রকল্পের প্রভাব অনেক বিশেষ গুরুত্ব বহন করবে।
বৈশ্বয়িক উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রভাবে গলে যাচ্ছে হিমালয় শীর্ষের সঞ্চিত বরফঃ
হিমালয় পর্বতমালা ৩৫,১১০ বর্গ কিমি ব্যাপ্ত ৩৭৩৫ ঘন মিটার বরফের যে বিপুল আধার ধারণ করে আছে, তার কারণে হিমালয় অঞ্চলের আরেক নাম ‘তৃতীয় মেরু’ বা Third Pole। Global Warming এর কারণে বিগত কযেক দশকে আসঙ্কাজনকভাবে এই বরফ ক্রমবর্ধমান হারে গলে যাচ্ছে। এ বিষয়ে সচেতন পাঠক মাত্র অবগত। হিমালয়ের পাদদেশে যে টিপাইমুখ জল বিদ্যুত প্রকল্প হতে যাচ্ছে , তা হবে সেই প্রক্রিয়াকে ত্বরাণিত করার আরেক নতুন উৎস।
টিপাইমুখ জল বিদ্যুত প্রকল্পে ভূমিকম্পজনিত ঝুঁকির কথা বিশেষভাবে সর্বমহলে আলোচিত হয়েছে। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে , প্রকল্পের নির্মাণে সর্বোচ্চ ভূমিকম্প ঝুকি বিবেচনায় করা হবে। এ বিষয়টি নিয়ে বির্তক এ লেখায় আর না বাড়িয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ঝুকির কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।
এ ধরণের জল বিদ্যুত প্রকল্পের বাঁধ নির্মাণ করা হয় প্রবাহমান জলধারার ঐতিহাসিক প্রবাহ চিত্র বা ডাটা বিশ্লেষণ করে । বাঁধ ডিজাইনারা ধরে নেন যে, ভবিষ্যতেও নদী উর্ধ্ব অববাহিকার জল প্রবাহ সুদূর অতীতের মতই থাকবে।
কিন্তু,Global Warming এর কারণে হিমালয় থেকে ধেয়ে আসা নদীর প্রবাহ ক্রমবর্ধমান ভাবে বাড়ছে । তাই অদূর ভবিষ্যতে সার্বিক Global Warming এর প্রভাব হিমালয়ের বরফ গলার হারের উপর কি প্রভাব ফেলবে তা অনুমাণ করে বাঁধ ডিজাইন করাটাই জরুরী ।
এ টা সবচেয়ে বড় সত্য যে , ভবিষ্যত জলপ্রবাহ স্বরূপ অনুধাবন করে বাঁধ নির্মাণ করা সম্ভব নয়। কেননা, আমরা সমগ্র বিশ্বের মানুষ আগামী ২০ কিংবা ৫০ বছরের Global Warming কে কোন পর্যায়ে নিয়ে দাড় করা সেটা কেউ কল্পনা করতে পারছি না।
প্রশ্ন উঠতে পারে যে, কল্পনাই যেখানে করতে পারছি না সেখানে এ তো উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ কি? কারণ , Global Warming কারণে ভবিষ্যত জলপ্রবাহের উপর বিরূপ প্রভাব অনুধাবনের ব্যর্থতা যে দূর্ঘটনার কারণ হতে পারে, তা হিমালয় অঞ্চলের জল বিদ্যুত প্রকল্পের ক্ষেত্রেই নজির হিসাবে দাড়িয়ে আছে। Global Warming এর বিরূপ প্রভাবে Langmoche হিমবাহর প্রান্ত শৈল ধ্বসে ১৯৮৫ সালে নেপালের Dig Tsho Glacial Lake দূর্ঘটনায় উৎপাদন শুরু আগেই একটি ছোট জল বিদ্যুৎ প্রকল্প বিধ্বস্ত হয় এবং তা নিম্ন অববাহিকার বিস্তৃর্ণ এলাকা কে বিপর্যস্ত করে ছিল।
টিপাইমুখ জল বিদ্যুত প্রকল্প হিমালয় অঞ্চলের একমাত্র জল বিদ্যুত প্রকল্প নয়ঃ
ভারত , পাকিস্তান , নেপাল ও ভুটান আগামী ২০ বছরে টিপাইমুখ জল বিদ্যুৎ প্রকল্প মত আরও ৪৪৯ টি জল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে ১•৫ লক্ষ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের মহা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। আর এ সব প্রকল্প গন্ধে ছুটে এসেছে বিশ্বব্যাংক সহ তাবৎ দুনিয়ার সকল বড় বড় অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান। উল্লেখ্য, এ অঞ্চলে বিদ্যমান জল বিদ্যুৎ প্রকল্প প্রকল্পের সংখ্যা ১০০ যা সর্বমোট উৎপাদন মতা ২৩,৬১৮ মেগাওযাট। হিমালয়ের বুকে বিদ্যমান ও আগামী ২০ বছরে নির্মিত্যব পাঁচ শতাধিক জল বিদ্যুৎ প্রকল্পের সম্মিলিত গ্রীনহাউজ গ্যাস আর এই গ্রীনহাউজ গ্যাস সৃষ্ট Global Warming জনিত প্রভাবে হিমালয়ের সামগ্রিক বিপর্যয় চিন্তা করলে যে কারও অন্তরাত্ম কেঁপে উঠবে।
টিপাইমুখ আন্দোলন কে বিছিন্ন করে দেখবার কোন অবকাশ নাইঃ
আমরা যদি শুধু মাত্র টিপাইমুখ জল বিদ্যুত প্রকল্প বিরোধী আন্দোলন কে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নিজেদের নিবেদিত রাখি , তবে সে টা মস্ত ভুল হবে। কেননা, টপাইমুখ জল বিদ্যুত প্রকল্প একটি মহা পরিকল্পনার ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। একটি প্রকল্প বন্ধ করে আসন্ন মহা পরিবেশ বিপর্যয় রোধ কার যাবে না। আমি সন্দিহান বিছিন্নভাবে বাংলাদেশীদের বহু ধারায় বিভক্ত আন্দোলন আদৌ ভারতের শাসক গোষ্ঠি কে টিপাইমুখ জল বিদ্যুত প্রকল্প হতে পিছু হটাতে পারবে কিনা। সে প্রসঙ্গে পর লিখবার আশা রাখি।
তাই, বিশ্ব কে ভবিষ্যত প্রজন্মের বাসযোগ্য করে রক্ষার জন্য ‘টিপাইমুখ বাঁধ বিরোধী আন্দোলন’ হযে উঠুক দেশ-কাল- জাতি -ধর্ম- বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা।
আগ্রহীদের youtube সংক্ষিপ্ত ভিডিও ফুটেজ টি দেখতে অনুরোধ করলাম
Click This Link
-----------------------------------------------------------------
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ
১। Hydroelectric power's dirty secret revealed
Click This Link
২।| Hydroelectric Dams Stoke Global Warming
Click This Link
৩। Mountains of Concrete: Dam Building in the Himalayas.
http://www.internationalrivers.org/node/3601
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুলাই, ২০০৯ রাত ৯:৪৮