লক নেস হচ্ছে স্কটল্যান্ডের হাইল্যান্ডে অবস্থিত একটি হ্রদ। হ্রদটির আকার প্রায় ৫৩ মাইল। আয়তনের দিক থেকে এটি স্কটল্যান্ডের সবচেয়ে বড় হ্রদ। গভীরতার দিক দিয়েও এটি স্কটল্যান্ডের সবচেয়ে বড় হ্রদ। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক হ্রদটি দেখতে আসেন। কিন্তু সমস্যা হ্রদ নিয়ে নয়। হ্রদের মধ্যে রয়েছে এক আশ্চর্য দানব যার নামকরন করা হয়েছে "লক নেস" 'Loch Ness' । পর্যটকরা শুধুমাত্র ‘নেসি’ নামক জলদানব এর রহস্য উদঘাটন করার জন্যই এই হ্রদটি ভ্রমণে আসেন। কিন্তু আজও পর্যন্ত কেউ এই রহস্য উদঘাটন করতে পারেন নি। নেসি কি আসলেই সত্যিকারের কোন জলদানব? নাকি মানব মনের সৃষ্ট কল্পনা ? লক নেস কে ঘিরে কেনই তবে এই রহস্য ?
আসলে বিশ্বে এখন পর্যন্ত যেসব অমিমাংসিত রহস্য রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম প্রধান এই লক নেস। প্রাগৈতিহাসিক যেসব দানবের কলাপনা করা হয়, তাদেরকে কেবল কল্পনাতেই রাখা হয়। কিন্তু লক নেস প্রাগৈতিহাসিক হলেও এর বাস্তব উপস্থিতি সম্পর্কে বহু প্রমান আছে বলে দাবি করা হয়।
রহস্যের সূচনা এবং উদঘাটন:--
সর্বপ্রথম যে বক্তব্যটি শুনা যায় সেটি হল, ৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় রহস্যময় ‘নেসি’ ঘটনা। সেইন্ট কলম্বো হ্রদে সাঁতার কাঁটা অবস্থায় এক লোক ভয়ংকর এই প্রাণীটির কবলে পড়ে। কোনোরকমে সে বেঁচে ফিরে আসে। প্রথম প্রথম এটিকে পরিচিত প্রাণী হিসেবে ভাবলেও ধীরে ধীরে এই রহস্য ঘনীভূত হতে থাকে।
১৯৩৩ সালে লক নেস হ্রদের মধ্যে ভ্রমনে গিয়েছিলেন দুই বন্ধু। নৌকায় থাকা অবস্থায় পানিতে কিছু আলোড়ন বুঝতে পারেন তারা। যখন ভালো করে লক্ষ করলেন তখন তারা এক আশ্চর্য কিছু অবলোকন করেন। তাদের ভাষ্য ছিল এটি একটি জীবন্ত প্রানী যা প্রায় ৩০ ফুট এর মতো লম্বা , মাথার শুরু এবং দেহের শেষটাও অনেকটা সাপের মতো। রের বছরই একজন ছাত্র মোটরসাইকেল চালিয়ে আসার সময় হ্রদের পাশের রাস্তায় কোন একটা বিশাল প্রাণীর সাথে প্রায় ধাক্কা খায়। ছেলেটার বর্ণনা অনুসারে প্রাণীটি সরীসৃপ গোছের বিশালাকৃতির, যার মাথা অনেকটা সাপের মতো। আগের বর্ণনার সাথে ছেলের দেয়া বর্ণনাও অনেকটা মিলে যায় ।
তারপর ১৯৩৪ সালে স্যার এওয়ার্ড মাউন্টেন এর নেতৃত্বে একটি ২০ সদস্যের একটি দল হ্রদটির চারপাশে অনেক গুলে ক্যামেরা নিয়ে সন্ধ্যা ৬-৯ পর্যন্ত অবন্থান করে। তারা প্রায় ২৫ টি ছবি তুলে। পরর্বতিতে প্রাণীবিদ গন গবেষণা করে কিছু একটা সমস্যা চিহ্নিত করেন।
১৯৬৩ সালের জুলাই মাসে নেসিকে দেখতে পান এক ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা। তারা হ্রদটির পাশ দিয়ে গাড়ি চালানোর সময় দেখলেন ডাঙায় শুয়ে রোদ পোহাচ্ছে কোন একটা বিশাল আকৃতির প্রাণী। মানুষের উপস্থিতি টের পেয়েই প্রাণীটি সঙ্গে সঙ্গে তলিয়ে গেল। তাদের মতানুসারে প্রাণীটি ছিল প্রায় ৪০ ফুট দীর্ঘ।
রবার্ট রাইসন। তিনি দীর্ঘদিন এই জলদানব রহস্য নিয়ে কাজ করছেন। ১৯৭২ সালে তিনি সূক্ষ্ম কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে হ্রদে অভিযান চালালেন। আগস্টের আট তারিখে তার দলের সদস্যরা নৌকায় অপেক্ষা করছিল। রাত একটার দিকে পর্যবেক্ষণে এক বিচিত্র প্রাণীর অস্তিত্ব ধরা পড়ে, যার রয়েছে বিরাট আকারের ডানা। লম্বায় সেই ডানা ছয় ফুটের মতো। ড. রাইনসের মতে, আজ থেকে সাত কোটি বছর আগে পৃথিবীতে এরকম প্রাণী ছিল
এরপরই শুরু হয়ে যায় ‘নেসিকে’ নিয়ে হইচই। হ্রদের চারপাশে বসানো হয় অসংখ্য ক্যামেরা। কিন্তু এতসব ক্যামেরার পক্ষে পরিষ্কার কিছু তোলা সম্ভব হয় নি। ক্যামেরায় যেই ছবিগুলো তোলা হয়েছিল সেগুলোতে দেখা যায় শুধুমাত্র পানির আলোড়ন ও কিছু ভি আকৃতির ফেনার ছবি। তবে লন্ডনের এক ডাক্তারের তোলা ছবিতে নেসিকে মাথা তোলা অবস্থায় দেখা যায়। ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত অনেকে সত্য বললেও এর কয়েক বছর পরই প্রমাণিত হয় যে এই ছবিটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। এরকম আরও অনেকে রহস্যময় এই জলদানবটিকে দেখেছেন বলে দাবি করেন। কিন্তু নেসি চিরকালই পুরোপুরি ধরা না পরে মানুষকে ফাঁকি দিয়ে গেছে ।
তাই এতো এতো রহস্যের মধ্যে গা গুটিয়ে বসে থাকতে পারলেন না বিজ্ঞানীরা। নেসিকে খুঁজতে ১৯৭০ সালে প্রথম বৈজ্ঞানিক অভিযান শুরু হয়। তারা নেসিকে খুঁজতে আণ্ডারওয়াটার ক্যামেরা থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক সব যন্ত্র নিয়ে নিমে পড়েন হ্রদটিতে। অভিযানের একপর্যায়ে একটি ছবি তোলা হয় পানির নিচ থেকে, যাকে দেখলে ২০ ফুটের মতো লম্বা একটা প্রাণী বলেই মনে হয়। পরে নিশ্চিত হওয়া গেল যে, এটা একটা গাছ ছাড়া কিছুই না। এ অভিযানেও বিজ্ঞানীরা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি।
২০১১ সালে আবারো হঠাৎ বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলে দিয়েছিল য়ক নেস। ২০১১ সালে এই হ্রদের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছিল দুটি নৌকা। হঠাৎ বিশাল এক ঢেউ এসে নৌকা দুটিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। তারপর থেকে নতুন করে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে লক নেস হ্রদ ও রহস্যময় জলদানব কাহিনী। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও এই রহস্যের কোনো কুলকিনারা গবেষকরা করতে পারেন নি। তারপরও তারা বলছেন প্রাগৈতিহাসিক জলদানবই এর মূল হোতা।
নেসির আকৃতি :--
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিজ্ঞানীগণ এই প্রাণী সম্পর্কে নানা ধারনা দিয়েছেন।
কানাডার ভেনকুভারের সমুদ্রবিজ্ঞানী পল লি ব্লন্ড মতে, লম্বা গলা, অনেক কুঁজ, মাছের মতো ডানা, হলুদ পেট, বাইন বা সাপ জাতীয় মাছের মতো, ভোঁদড় জাতীয়, সামুদ্রিক ঘোড়ার মতো, সামুদ্রিক চতুষ্পদ সরীসৃপ যেমন কুমিরের মতো এবং কচ্ছপের পূর্বসূরীয় জাতের।
ওয়াশিংটনের জেনেরোস স্পিটে একটি রহস্যময় প্রাণী দেখা যায়। অদ্ভুত প্রাণীটির দেহে খয়েরি রংয়ে উজ্জ্বল কমলার মিশ্রণ রয়েছে। ছয় ফুট লম্বা গলা, পিঠে তিনটি কুঁজ এবং দীর্ঘ কেশর ছিল তার।
১৯৮৪ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকৌশলী জিন থমসন মাছ ধরতে বেরিয়েছিলেন। ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঁচ মাইল দূরে। হঠাৎ জিন দেখলেন, তার ২০০ ফুট দূরে হঠাৎ একটি প্রাণী ভেসে উঠেছে। জিন সেই প্রাণীটির বর্ণনা দিচ্ছেন, ২০ ফুট লম্বা ও দুই ফুট চওড়া হবে প্রাণীটি। সাদা তামাটে রংয়ের গলা এবং তার লম্বা লম্বা কানগুলো দোল খাচ্ছিল। লাজুক ও কৌতূহলী এই প্রাণীটি আমাকে দেখে অবাক হয়েছে বলে মনে হল। তারপর সে চলে যেতে চাইল। কয়েকবার মাথা ঝাঁকিয়ে সাঁতার কেটে চলে গেল ওটা। সাঁতার কাটার সময় তার দেহ মোচড় খাচ্ছিল।
১৭৩৪ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে নরওয়ের এক ধর্মপ্রচারক পালতোলা জাহাজে করে গ্রিনল্যান্ডে যাচ্ছিলেন। তার নাম হাসন এগেড। তিনি সে সময় সমুদ্রে একটি অদ্ভুত এবং ভয়ানক জীব দেখেছিলেন। পানি থেকে উঠে প্রাণীটির গলা জাহাজে পড়েছিল। তিমি মাছের মতো ফোয়ারা তুলেছিল। দু’পাশে ছিল বড় ডানা।
১৯৫১ সালে বন বিভাগের কর্মী মি. এল স্টুয়ার্ড নেসিকে পানি ছিটাতে ছিটাতে বহুক্ষণ ভেসে থাকতে দেখেছেন। তার বর্ণনায়, লম্বা গলার উপর মাথাটা অবিকল ভেড়ার মতো। পিঠে কয়েকটি কুঁজ এবং সব মিলিয়ে লম্বা প্রায় ১৫ মিটার।
সাম্প্রতিককালে ইকো ব্যবহার করে লক নেসের তলদেশে বিশাল এক গুহা বা খাদ আছে বলে ধারণা করছেন গবেষকরা। অনেকের মতে, ১৫০০ বছর আগের কোনো এক প্রাণীর উত্তরসূরি হলো আজকের নেসি। তবে এটি শুধু গবেষকদের ধারণা কিংবা মতামত। আধুনিক এই বিজ্ঞানের যুগেও পৃথিবীর বুকে এক অপার রহস্য হয়ে আছে জলদানব নেসি।








তথ্য সূত্র:-- ১।https://en.wikipedia.org/wiki/Loch_Ness_Monster
২।http://www.online-dhaka.com/139_1411_27403_0-loch-ness-lake-and-mysterious-animal-nessy.html
৩। Click This Link