২১ ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস এবং ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস'। আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। আমরা অন্তর থেকে চিৎকার দিয়ে বলতে পারি ‘আমরা বাঙালি’। দিনটি উদযাপিত হয় সারা বিশ্বে। আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি. আমি কি ভুলিতে পারি” স্পর্শ করে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের হৃদয় পর্যন্ত। সারা বিশ্বের মানুষ জানতে পারে সাহসী বাঙালি জাতির সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রক্তের বিনিময়ে মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার কথা। শ্রদ্ধা জানাই ভাষা শহীদদের, ভাষা সৈনিকদের বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে যাঁরা সদা সচেষ্ট, আর যাদের আপ্রাণ চেষ্টায় জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত হয় ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’।
ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস একটু পেছন থেকে দেখলে আমরা দেখতে পাই জিন্নাহর দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে দুটি পৃথক রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়। দেশ বিভাগের প্রাককালে জিন্নাহ ছিল সর্ব ভারতীয় মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতা। তার আধিপত্ব্য ও একক নেতৃত্ব বজায় রাখার লক্ষ্যেই তিনি দ্বি-জাতিতত্ত্বের ঘোষণা দেন। ধর্মের অজুহাতে তিনি তার আকাঙ্খা পূরণে সচেষ্ট থাকেন। তিনি যখন বুঝতে পারলেন ভারতবর্ষ অখন্ড থাকলে তার একক নেতৃত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয়, তখন তিনি ভারত বিভাজনের সব রকম প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখেন। প্রধান অস্ত্র হিসেবে বেছে নেন ধর্মকে। মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রসমূহ দাবি করেন। ভারতীয় মুসলমানদের তিনি বোঝাতে সম হন যে মুসলমানরা অখন্ড ভারতবর্ষে নিরাপদ নয়। এ জন্য ১৯৪০ সালে তিনি লাহোর প্রস্তাব পেশ করেন। অন্যদিকে তিনি হিন্দু নেতাদের সাথে দন্দে লিপ্ত থাকেন। এ অব্যাহত প্রক্রিয়ায় এক সময় নিশ্চিত হয়ে যায় ভারত বর্ষ আর এক থাকা সম্ভব নয়। তখন তিনি শুরু করেন আর এক প্রতারণার ষড়যন্ত্র। লাহোর প্রস্তাবের Independent States শব্দটিকে Independent State বানিয়ে দেন। অর্থাৎ মুসলমান প্রধান এলাকা নিয়ে আলাদা রাষ্ট্রসমূহ গঠনের পরিবর্তে মুসলমান প্রধান এলাকা নিয়ে একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের কথা ঘোষণা দেন। এটা তার একক নেতৃত্ব বজায় রাখার নির্লজ্জ স্পর্ধা। কারণ জিন্নাহ বাংলার সম্পদ এবং নেতৃত্বের লোভ সংবরণ করতে পারেন নি। তিনি আরো বুঝতে পারেন যে, অখন্ড বাংলা (পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলা) তার একক নেতৃত্বের অন্তরায়। তাই তিনি অখন্ড বাংলার দাবিকে সমর্থন না করে তীব্র বিরোধিতা করেন। একটি বারের জন্যও ভাবলেন না দুই বাংলার মানুষের ভাগ্যের কথা- ভবিষ্যতের কথা। তিনি শুধু পাকিস্তানের জাতির পিতা হবার স্বপ্নে বিভোর হয়ে রইলেন। এর সঙ্গে তিনি আরেকটি বিষয়কে অবজ্ঞা করেন; তা হলো ভারতের বাকি অংশে বসবাসরত ৪ কোটি মুসলমানের ভাগ্যে কি হবে? যাদের অধিকাংশ মুসলিম লীগ করতেন এবং জিন্নাহকে তাদের নেতা মানতেন। এটাও কি একটা বড় প্রতারণা নয়? তিনি কি সত্যিই মুসলমানদের নেতা ছিলেন? এরপর তিনি প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা করেন বাঙালি জাতির সাথে দেশ বিভাগের পর। তিনি বাঙালিদের মনে প্রাণে ঘৃণা করতেন। বাঙালি মুসলমানদের তিনি মুসলমান মনে করতে কুন্ঠাবোধ করতেন। কোণঠাসা করে রাখতে চাইতেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হকের মত প্রকৃত দেশপ্রেমিক নেতাদের। তার এবং তার অনুসারীদের কুচক্রে ১৯৪৬ সালে সৃষ্টি হয় হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা। হিন্দুরা হত্যা করে মুসলমানদের, মুসলমানরা হত্যা করে হিন্দুদের। এ হত্যাযজ্ঞের প্রকৃত অপরাধী ভারতের কতিপয় হিন্দুনেতা এবং মুসলমানদের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে তিনি এবং তার অনুসারীরা। দেশ বিভাগের সময় ঢাকার অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য যে ৩৩ কোটি টাকা ভারত সরকার কর্তৃক প্রদানের চুক্তি হয়েছিল, তা গ্রহণ করার কোন পদক্ষেপ তিনি বা পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন কেউই গ্রহণ করেননি।
মুসলমান হয়েও তিনি নিয়মিত মদ্যপান করতেন। তিনি নামাজ পরতেন না। তিনি বাঙ্গালি জাতির সাথে বহুবার প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। তিনি বাঙালি মুসলমানদের মুসলমান ভাবতে কুন্ঠাবোধ করতেন। তাহলে তিনি নিজেই কি মুসলমান ছিলেন?
পাকিস্তান সৃষ্টির পর তিনি বাঙালি জাতিকে দাবিয়ে রেখে শাসকরূপে শোষন করে বাংলার অর্থ সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচারের পরিকল্পনা করেন। আর এ জন্য প্রয়োজন পাকিস্তানের নেতৃত্ব থেকে বাঙালিকে দূরে সরিয়ে রাখা। বাঙালিকে নেতৃত্ব থেকে দুরে রাখার লক্ষে তিনি বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দিতে অস্বীকার করেন। তার আধিপত্য ও একক নেতৃত্ব বজায় রাখার জন্য তিনি চাইতেন যে, কেবল তার অনুসারীরাই নেতৃস্থানে আসীন থাকুক।
দেশ বিভাগের পূর্বে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ প্রস্তাব করেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হবে উর্দু। এ প্রস্তাবে বিরোধিতা করে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ দাবি করেন উর্দুর পরিবর্তে রাষ্ট্র ভাষা হবে বাংলা। দেশ বিভাগের পর ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্র“য়ারি গণ পরিষদ সদস্য কুমিল্লার শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দুর সাথে সাথে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবি করেন। পাকিস্তানের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। তাই বাংলাই হওয়া উচিৎ ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা। জিন্নাহ ছিলেন বাঙালি বিদ্বেষী। তিনি বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করতেন-হিন্দুদের ভাষা বা চাষা ভূষাদের ভাষা হিসেবে।
১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রথম এবং শেষ বারের জন্য ঢাকায় আসেন। ২১ মার্চ বিকেলে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) তাকে নাগরিক সংবর্ধনা দেয়া হয়। এখানেই তিনি ঘোষণা করেন ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা’। সম্পূর্ণ ভাষণটি তিনি দেন ইংরেজি এবং উর্দুতে। মুহূর্তের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে তা প্রতিবাদে পরিণত হয়। জিন্নাহকে ইন্ধন যোগায় অবাঙালি আমলারা এবং জনবিচ্ছিন্ন খাজা নাজিমউদ্দিন। ফলে ভাষা প্রসঙ্গে জিন্নাহ অনমনীয় থাকেন। তিনি বিশ্বাস করতেন- সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে বাঙালিরা নরম হয়ে যাবে। বাঙালি জাতিকে মেরুদন্ডহীন ভাবতেই তিনি সুখানুভব করতেন। ১৯৪৮ সালের শুরুতেই বাঙালিরা বুঝতে পারেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানিদের মূল উদ্দেশ্য হলো আমাদের বঞ্চিত করা। তাই পশ্চিমা শাসকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার লক্ষে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলা মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন গঠিত আওয়ামী মুসলিমলীগ। পরবর্তীতে মুসলীম শব্দটি বাদ দিয়ে সর্বস্তরের বাঙালির আশা আকাঙ্খার প্রতিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
পাকিস্তানী শাসকদের অনমনীয় দমন ও শোষনের প্রতিবাদে ধারাবাহিকভাবে সৃষ্টি হয় ৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ সালের বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা দাবি, ৬৮ সালের আগরতলা যড়যন্ত্র মামলা, ৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থান, ৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের নিরঙ্কুশ বিজয়, অতঃপর ৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের চিরতরে বিতারণের মাধ্যমে অর্জিত হয় আমাদের কাঙ্খিত স্বাধীনতা। বাংলা ভাষা এককভাবে অর্জন করে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা। সময়ের সাথে সাথে এগিয়ে চলে সমৃদ্ধির পথে। জিন্নাহ ও জিন্নাহর অনুসারীদের বিরুদ্ধে যদি বাঙালি জাতি সোচ্চার না হতো তাহলে হয়তো আজও আমরা থাকতাম পরাধীন, সর্বত্রই থাকতো উর্দু ভাষার নেতৃত্ব। রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সংবাদ মাধ্যম, চলচ্চিত্র, বেতার, টেলিভিশন, সর্ব প্রকার সাইনবোর্ড, ব্যানার, সড়কের নাম, যানবাহন, নির্বাচনী প্রচার, ভোগ্য পণ্যের লেবেল, বিজ্ঞাপন সর্বত্রই থাকতো উর্দু ভাষার প্রাধান্য। অবজ্ঞা অবহেলায় ধীরে ধীরে ধ্বংসের মুখে পতিত হতো আমাদের মাতৃভাষা। আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের পশ্চিম বাংলায় যা খুব তীব্রভাবে লক্ষণীয়। ভারতের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বেশ কয়েক বছর আগে বলেছেন,“আগামী পঞ্চাশ বছর পরে বাংলা ভাষার চর্চা হবে কেবলমাত্র ঢাকা কেন্দ্রিক”। এই বক্তব্যের তাৎপর্য বাংলা ভাষা গবেষকদের ভাবনার বিষয়। পশ্চিম বাংলার গ্রামাঞ্চলের মানুষ আঞ্চলিক বাংলায় কথা বললেও শহরাঞ্চলে বিশেষভাবে কলকাতার অধিকাংশ বাঙালির ইংরেজি ও হিন্দি শিক্ষা ও চর্চার প্রভাবে বাংলা ভাষা আজ মৃত্যুমুখে। একটি বিরাট অংশের মধ্যে লক্ষ করা যায় যে, তারা সর্বদা কথা বলার সময় দুই বা ততোধিক ভাষার সমন্বয়ে একটি বাক্য গঠন করে থাকেন। এই ভাষার ভবিষ্যত কি? এ ভাষা বাংলা ভাষার জন্য কতটুকু ক্ষতিকারক তা নির্ধারণ ও প্রতিকার অতি আবশ্যক।
উর্দু ভাষার জন্ম সম্পর্কে জানতে গেলে আমরা দেখতে পাই উর্দু ভাষাটি মূলত হিন্দির আদলে (ব্যাকরণে) ফার্সি, আরবি ও ভারতবর্ষের কিছু স্থানীয় শব্দ দ্বারা গঠিত। শত শত বছর পূর্বে পশ্চিমা মুসলমানরা যখন ভারতবর্ষ শাসন করতে আরম্ভ করেন তখন সরকারি ভাষা ছিল তাদের নিজস্ব মাতৃভাষা ফার্সি। আর প্রজারা ছিল স্থানীয় বিভিন্ন ভাষাভাষী। শাসক এবং প্রজাদের মধ্যে ভাব বিনিময়ের লক্ষে ধীরে ধীরে একটি মিশ্র ভাষা উৎপত্তি লাভ করে দিনে দিনে সমৃদ্ধ হতে থাকে। মুঘল সম্রাট শাহজাহান সর্বপ্রথম এটিকে উর্দু ভাষা হিসেবে ফার্সির পাশাপাশি রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা ও স্বীকৃতি দেন। উর্দু শব্দের অর্থ হচ্ছে সেনা ছাউনী। সম্রাট শাহজাহান আগ্রা থেকে দিল্লিতে রাজধানী স্থানান্তরের সময় সর্ব প্রথম বর্তমান পুরাতন দিল্লি এলাকায় একটি দূর্গ বা সেনা ছাউনী তৈরি করেন। দূর্গের পাশে একটি বাজার তৈরি করা হয়, যার নাম দেয়া হয় উর্দু বাজার এবং দূর্গে যাতায়াতের জন্য তৈরি সড়কের নাম রাখা হয় উর্দু সড়ক। এ থেকেই সম্রাট শাহজাহানের পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু উর্দু ভাষার সমৃদ্ধি অর্জন। উর্দু ভাষাটি বিশাল এক শূণ্যতাকে পূরণের প্রয়োজনে জন্ম লাভ করে এবং সম্রাট শাহজাহান কর্তৃক রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা লাভ করে। কিন্তু বর্তমানে পশ্চিম বাংলায় যে সব খিচুরী ভাষার প্রচলন হচ্ছে তার হয়তো নাম দেয়া যেতে পারে বাংলিশ, হিংলিশ, হিংলা বা বান্দি কিংবা অন্যকিছু। নাম যাই দেয়া হোক মূল কথা হচ্ছে এর আদৌ কোন প্রয়োজন আছে কি না ? কি ভবিষ্যত এ ভাষার ? যে ভাষা দিন দিন মৃত্যুমুখে ঠেলে দিচ্ছে বাংলা ভাষাকে।
শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক তখন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর। তার বাড়িতে তাকে সঙ্গে নিতে এসেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। দোতলা থেকে নামার সময় সিঁড়িতে সোহরাওয়ার্দী সাহেব বললেন-“আমি কি আপনাকে সাহায্য করবো?” জবাবে বৃদ্ধ শেরে বাংলা বললেন, “উপরে উঠতে হলে মানুষের সাহায্য প্রয়োজন হয়। কিন্তু নিচে নামতে কারো সাহায্য প্রয়োজন হয় না।” শেরে বাংলার এ জবাবটি পৃথিবীর সর্বকালের সব মানুষের জন্য সমান ভাবে সত্যি।
একজন লেখককে (যিনি একটি ভাষাকে পুষ্টি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখেন, অলংকারে সাজিয়ে রাখেন) প্রতিষ্ঠা পেতে হলে সর্ব প্রথম প্রয়োজন সাধারণ মানুষদের স্বত:স্ফূর্ত উৎসাহ। আমরা যদি দুই বাংলার জনপ্রিয় সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা ভাবি তাহলে দেখবো তার সমগ্র জীবনে বাঙালির ব্যাপক উৎসাহ পেয়েছিলেন বলেই তিনি তার মেধার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটিয়ে সাফল্যের শিখড়ে বসে বাংলা ভাষাকে বহু অমূল্য সম্পদে সমৃদ্ধ করেছেন। শুধু তার লেখনীই নয় ব্যক্তি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আজ বাঙালী জাতির অমূল্য সম্পদ। একদিন তিনি থাকবেন না। বাঙালি পরিবারে তখনও জন্ম নেবে মেধাবী সন্তান। কিন্তু সে সন্তানকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ধারের কাছে নিয়ে যাবার জন্য তখন কতজন বাঙালি অবশিষ্ট থাকবে পশ্চিম বাংলায় ?
পশ্চিম বাংলার শিক্ষিত বাঙ্গালিদের লক্ষ করলে দেখা যাবে তাদের একটি অংশ আজ পুরোপুরি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরেছে। একটি অংশ আংশিকভাবে বাংলার সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে। যে কলকাতা শহরে বাংলাভাষা শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের পরিপূর্ণতা লাভ করে, সে শহর কলকাতাকে বর্তমানে ধীরে ধীরে গিলে ফেলছে অবাঙালি ভাষা ও সংস্কৃতি। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে এক সময় তা গিলে ফেলবে জেলা শহরগুলোকে তারপর মহকুমা, থানা, পঞ্চায়েত এবং গ্রাম। অনেক দেরিতে হলেও সম্প্রতি পশ্চিম বাংলার প্রাদেশিক সরকার বাংলাভাষা সংরক্ষনার্থে কিছু কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করছে। কিন্তু এ উদ্যোগ কতটুকু ফলপ্রসু হবে তা দীর্ঘ দিনের পর্যবেক্ষণের বিষয়।
বিশ্বায়নের এই ক্ষণে মাতৃভাষার সাথে সাথে একাধিক ভাষা শিক্ষা শুধু মাত্র লাভ জনক নয়, অতি আবশ্যক বটে। একাধিক ভাষা শেখা শুধু একজন ব্যক্তিকেই নয় পাশাপাশি তার দেশকে খুলে দিতে পারে উন্নয়নের নতুন নতুন দরজা, যদি তা সঠিক স্থানে সঠিক প্রয়োগ করা হয়। বিদেশী ভাষা শিক্ষা গ্রহণের সময় উদ্দেশ্য থাকতে হবে তা যেন দেশের এবং মাতৃভাষার উন্নয়নে সহায়ক হয়। বিদেশী ভাষা দ্বারা মাতৃভাষাকে ক্ষতিগ্রস্থ করা অবশ্যই চরম অপরাধ। জ্ঞান তাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯টি ভাষায় লিখতে, পড়তে ও কথা বলতে পারতেন। একজন খাঁটি মুসলমান ও খাঁটি বাঙালী হিসেবে আমরণ তিনি ছিলেন বাংলা ভাষার গবেষক, সাধক ও সেবক। বিদেশী ভাষা থেকে জ্ঞান আহরণ করে তিনি বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন। তার গবেষণালব্ধ জ্ঞান থেকে বাঙালির সামনে তুলে ধরেছেন বাংলা ভাষার গুপ্ত ইতিহাস।
বহুদিন আগে বৃটিশ সাংবাদিক এ্যান্থনী মাসকার্নহাস এর লেখা ‘বাংলাদেশ: এ লিগাসি অব ব্লাড’ বইটি পড়েছিলাম। বইটির এক জায়গায় লেখক আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে ইংল্যান্ডে ট্রেন ভ্রমন করার সময় বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘আপনি যখন একজন সৎ লোকের সাথে মোকাবেলা করবেন তখন অবশ্যই আপনি তার চেয়ে বেশি সৎ থাকবেন। আর যখন কোন প্রতারকের সাথে মোকাবেলা করবেন তখন অবশ্যই তার চেয়ে বড় প্রতারক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করবেন’। কথাটি এখানে বলার উদ্দেশ্য হলো একজন বাঙালির উচিত একজন ইংরেজের সাথে কথা বলার সময় সঠিক ইংরেজিতে, একজন ফরাসির সাথে কথা বলার সময় সঠিক ফরাসিতে, একজন হিন্দি বা উর্দু ভাষীর সাথে কথা বলার সময় সঠিক হিন্দি বা উর্দুতে কথা বলার চেষ্টা করা (যদি তিনি তা জানেন)। স্বেচ্ছায় কোন মিশ্র ভাষায় নয়।
অদূরদর্শী জিন্নাহর বিদ্বেষমূলক বক্তৃতা আর অনমনীয় জিন্নাহ অনুসারীদের বিরুদ্ধে সচেতন বাঙালির তীব্র প্রতিবাদের ফলে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষা নিয়ে অহংকার করতে পারি। কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যায় যে, ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা লাভ করার পর মহাত্মা গান্ধী, পন্ডিত জহরলাল নেহেরু কিংবা অন্য কোন রাষ্ট্র প্রধান বা সরকার প্রধান ভাষা সম্পর্কে জিন্নাহর মত একটি শব্দও উচ্চারণ করেন নি। তাই নির্বিঘ্নে আপন গতিতে ভারতের সর্বত্র হিন্দি ভাষার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। আজ শুধু সাড়া ভারতেই নয় হিন্দি ভাষা প্রসারিত হচ্ছে সমগ্র পৃথিবীতে। ভারতীয় চলচ্চিত্র, স্যাটেলাইট টিভি, সংগীত, উচ্চ শিক্ষার্থী ভারতীয় ছাত্র/ছাত্রী, শ্রমিক, মেধাবী পেশাজীবী, ভারতীয় খেলোয়ার, ভারতের উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী, ভারতে আগত বিদেশী পর্যটক, ছাত্র/ছাত্রী ও অন্যান্যদের মাধ্যমে হিন্দি ভাষাকে পৌঁছে দিচ্ছে পৃথিবীর সর্বত্র। আমরাও কি পারি না আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে আরো সমৃদ্ধ শক্তিশালী একটি ভাষা হিসেবে পৃথিবীর সর্বত্র পৌঁছে দিতে?
ভারতের সর্বত্র মানুষের মুখে মুখে যে ভাষাটি হিন্দি ভাষা নামে প্রচলিত তা কিন্তু আবার পুরোপুরি হিন্দি ভাষা নয়। এখানে রয়েছে উর্দু ভাষার বিশাল সংমিশ্রন। দু’একটি ধর্মীয় চলচ্চিত্র ব্যাতীত প্রায় সব হিন্দি চলচ্চিত্রই এ ভাষাতে তৈরীর হয়। আমরা যাকে হিন্দি গান বলে শুনি তা কিন্তু মোটেও হিন্দি গান নয়। একেবারে নিরেট উর্দু গান, যা লেখাও হয় উর্দু হরফে। পরবর্তীতে সুরকার ও শিল্পীর সুবিধাজনক ভাষায় লিখে তা রেকর্ড করা হয়। এ থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, ভারত বর্ষে কোন ভাষাই আর স্বকীয়তা বজায় রাখতে পারছে না। অনেক ভাষাই আজ সেখানে বিলুপ্তির পথে। প্রতিরোধ করার কেউ নেই। বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে হিন্দি চলচ্চিত্র, সংগীত এবং স্যাটেলাইট টিভির বদৌলতে কেউ কেউ শখ করে প্রচলিত হিন্দি ভাষার চর্চা করে থাকেন। বাংলাদেশে বিদেশী চলচ্চিত্র, সংগীত, স্যাটেলাইট টিভি এবং কম্পিউটার প্রযুক্তি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির অগ্রযাত্রাকে সাহায্য করার সাথে সাথে তিগ্রস্থ করছে ঠিকই, কিন্তু পুরোপুরি গ্রাস করার মতা রাখে না। বিদেশী ভাষার ক্ষতিকারক দিক গুলোর বিষয়ে এখনই সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
জিন্নাহর ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্র ভাষা সম্পর্কিত ঘোষণা এবং জিন্নাহ ও জিন্নাহর অনুসারীদের অনমনীয় দমন ও শোষননীতির বিরুদ্ধে সচেতন বাঙালির প্রতিবাদের ফলেই অর্জিত হয় আমাদের প্রাণ প্রিয় স্বাধীনতা। পাশাপাশি মহাত্মা গান্ধী বা অন্য কোন নেতা এরকম কোন ঘোষণা দেননি বলে প্রতিবাদের কোন সুযোগই সৃষ্টি হয় নি। তাই পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আজ বাংলাসহ অন্যান্য ভাষা দিন দিন ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে আমরা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির স্বকীয়তা রক্ষা করে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলেছি।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১২ বিকাল ৫:১২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




