
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের আপামর জনগণ শ্রদ্ধাভরা চিত্তে স্মরণ করে থাকে, অপরদিকে বিশ্ব মিডিয়া ও রেফারেন্স বইয়ে তিনি ক্যারিশম্যাটিক ব্যক্তিত্ব ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার সমার্থক হিসেবে সমাদৃত।
নিউজউইক ম্যাগাজিনের ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল সংখ্যাটির প্রচ্ছদ বঙ্গবন্ধুর জন্য উৎসর্গ এবং এতে তাঁকে স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া এতে তার ওপর রাজনীতির কাব্যকার শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়।
নিবন্ধে বলা হয়, কাঁচা-পাকা চুল, ঘন গোফ ও কালো চোখের অধিকারী দীর্ঘদেহী বাঙালি মুজিব (৫ ফুট ১১ ইঞ্চি) তাঁর সভায় লাখ লাখ লোকের সমাবেশ ঘটাতে এবং আবেগঘন বক্তৃতার মাধ্যমে তাদের মন্ত্রমুগ্ধ করতে পারতেন। এ অঞ্চলের সকল শ্রেণী ও মতের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষমতা তাঁর ছিল।
নিবন্ধে আরো বলা হয়, শেখ মুজিব যখন মার্চের (১৯৭১) শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন তখন তার কতিপয় সমালোচক এ কথা প্রচার করে যে তিনি উগ্র-সমর্থকদের দ্বারা পরিবেষ্টিত রয়েছেন এবং সময়ের অপেক্ষায় আছেন।
নিবন্ধে বলা হয়, নতুন বাঙালি জাতির সংগ্রামী নেতা হিসাবে মুজিবের আবির্ভাব মূলত: বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্য তাঁর আজীবন সংগ্রামের অনিবার্য ফসল। এই প্রাপ্তি তাঁর জন্য মোটেও অপ্রত্যাশিত ছিল না।
টাইম ম্যাগাজিনের ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি সংখ্যায় ভারতীয় উপমহাদেশে বিগত অর্ধশতাব্দীতে যে সকল নেতা অনন্য সাধারণ প্রতিভায় ভাস্বর ছিলেন তাদের ইতিহাস তুলে ধরা হয়। এরা হলেন মহাত্মা গান্ধী, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও জওহর লাল নেহেরু। এতে বলা হয়েছে, এখন এই তালিকায় আরো একটি নাম যুক্ত হতে যাচ্ছে তিনি হচ্ছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর (মুজিব) রহমান। এমনকি তার নিন্দুকেরাও স্বীকার করেন যে, অত্যন্ত সফল জননেতা হওয়ার মত গুণাবলী মুজিবের রয়েছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত এনসাইক্লোপিডিয়াগুলোর অন্যতম এনসাইক্লোপিডিয়া ডটকমে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলা হয়েছে, ক্যারিশম্যাটিক নেতা শেখ মুজিব তৃতীয় বিশ্বে উপনিবেশ বিরোধী নেতৃত্বের প্রতিমূর্তিতে পরিণত হয়েছিলেন।
এতে লেখা হয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫) ছিলেন একজন ক্যারিশম্যাটিক নেতা যিনি ভারতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংগঠিত করেন, উপনিবেশ-উত্তর পাকিস্তানি শাসকদের অন্যায় কার্যকলাপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালিদের নেতৃত্ব দেন এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
এতে বলা হয়েছে, শেখ মুজিবের জন্য শোষণ থেকে মুক্তির সংগ্রাম ছিল নিরন্তর। একারণে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা লাভ করার পরও শোষণমুক্ত বাঙালি সমাজ গড়ার স্বপ্ন তার অপূর্ণ থেকে যায়। এতে লেখা হয়েছে, যখন তিনি স্বাধীনতা-উত্তর ইতিহাসের কঠিনতম সময় পার হওয়ার ক্ষেত্রে কিছু সাফল্য লাভ করছিলেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছিলো তখনই নবীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক জুনিয়র অফিসারের এক অপরিকল্পিত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাঁকে এবং তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে হত্যা করা হয়।
লন্ডন অবজারভারের সাংবাদিক সিরিল ডান বলেন, বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসে শেখ মুজিবই একমাত্র নেতা যিনি ছিলেন রক্তে, গোত্রে, ভাষায়, সংস্কৃতিতে ও জন্মসূত্রে একজন পূর্ণাঙ্গ বাঙালি। তার কণ্ঠে ছিল বজ্রের নিনাদ। তার ক্যারিশমা জনগণের ওপর জাদুর মতো কাজ করতো। তার ব্যক্তিত্ব থেকে বিচ্ছুরিত সাহস ও আকর্ষণ তাঁকে এক অনন্যসাধারণে পরিণত করেছে।
পত্রিকাটির ২৮ মার্চ ১৯৭১ সংখ্যায় লেখা হয়, যদিও শেখ মুজিবকে তাঁর জীবনের এই বিস্ময়কর চুড়ায় পৌঁছতে ২০ বছরের বেশি সময় ব্যয় করতে হয়েছে, কিন্তু তাঁর স্বদেশ পূর্ব-পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশর গ্লানি থেকে মুক্ত এবং এর স্বাধীনতা অর্জনই ছিল তার প্রধান লক্ষ্য। তাঁর বিরুদ্ধে যা-ই বলা হোক, তিনি রাজনৈতিক সুবিধাবাদী নন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দ্য নিউইয়র্ক পোস্টর এক সংখ্যায় লেখা হয়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষায় কিছু কৃতিত্ব অর্জন করায় ওয়াশিটনের উচিৎ শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিশোধপরায়ণ বিচার ঠেকাতে একে ব্যবহার করা।
শেখ মুজিবুর রহমানকে গোপন বিচারে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলে তিনি পূর্ব-পাকিস্তান ও ভারত উভয় স্থানেই শহীদের মর্যাদা পাবেন এবং এর সত্যিকার শিকার হবে এশিয়ার শান্তি।
টরন্টো টেলিগ্রামে এ সময় মন্তব্য করা হয়, শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন রক্ষায় সহায়তার মাধ্যমে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের প্রশাসনকে কেবল আরো একটি অযথা হত্যাকাণ্ড থেকে নিবৃত্ত করাই নয়, বরং সম্ভবত গোটা উপ-মহাদেশকে নতুন করে গোলযোগে নিক্ষেপ করা থেকে বাঁচানো গোটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব। অস্ট্রেলিয়া ভিত্তিক অরসেইটার জেইটাঙ সংবাদপত্রে লেখা হয়, মুজিবের ফাঁসির অর্থ হবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক মৃত্যু।
ভারতের দি হিন্দুস্তান পত্রিকা লিখেছিল কোন বিচারই তাকে বিশ্ব দরবারে হেয় করতে পারবে না... প্রকৃত সত্য হচ্ছে মুজিব একটি ঐতিহাসিক নামে পরিণত হয়েছে, যে নাম গণতন্ত্রের পরিপূরক এবং শোষণ-বঞ্চনার প্রতিবাদী কন্ঠস্বর।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তান জেল থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তিতে বাঙালি জাতির আনন্দ উৎসবে সেদিন বিশ্ব গণমাধ্যমও যোগ দেয়।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তার ঐতিহাসিক মুক্তি প্রসঙ্গে ব্রিটেনের দি গার্ডিয়ান পত্রিকা মন্তব্য করে যে, মুজিবের ঢাকা বিমানবন্দরে পদার্পণের অর্থ হচ্ছে নতুন প্রজাতন্ত্রটির প্রকৃত অস্তিত্ব লাভ করা।
ব্রিটেনের বামপন্থী স্টেটমেন পত্রিকার ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে এক সংখ্যা বলা হয়, সামনের অল্প ক বছর বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক ও কঠিন সময়। তাই মুজিবের অনন্য নেতৃত্ব বাংলাদেশের অতীতের চেয়ে আরো বেশি প্রয়োজন হবে।
View this link
১. ০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০১০ বিকাল ৫:১৪ ০