somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রেজাউলের উচিত ছিল টিকটিকি হওয়া...

২৪ শে নভেম্বর, ২০০৬ রাত ৩:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক.
রেজাউলের কোন নর্িিদষ্ঠ দল ছিল না ।সে ছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কমর্ী।ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ছিল অনেক গুলো দলের সমষ্ঠি।কেউ ছিল আওয়ামী ছাত্রলীগ,কেউ জাসদ,কেউ আবার ছাত্র ইউনিয়ন অথবা ছাত্রফ্রন্ট।

এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে দলটলের তেমন একটা বালাই ছিল না। বিশেষ করে সিলেটের মতো মফস্বল শহরে আমরা যারা বয়সে কিশোর ছিলাম, তারা ছাত্রদল কিংবা ছাত্রলীগের তফাত খুব একটা বুঝতামও না।তবু আমাদের প্রত্যেকেরই ইচ্ছা ছিল রেজাউল আমাদের সংগঠনে আসুক।ছাত্রদলের কমর্ীরা রেজাউলকে টানতো নিজেদের দিকে,আবার ছাত্রলীগ আর জাসদ ছাত্রলীগের সমর্থকরাও আশা করতো রেজাউল তাদের সংগঠনে ভিড়ে যাবে।কিন্তু রেজাউল শুধু হাসতো আর বলতো,আরে দূর...,একদিকে থাকলেই হলো।মিছিলে তো রোজ আসি,আসি না..?

রেজাউলকে নিয়ে আমাদের টানাটানির মূল কারন ছিল তার দূরন্তপনা।ক্লাস টেনে থাকতেই সে এমন সব কান্ড করে ফেলতো যা এখনো আমার মতো অনেকের সাহসে কুলাবে না।সবচেয়ে দূঃসাহসী ছিল টিয়ার গ্যাস ছুড়ে মারা। ঢাকার মিরপুর বাংলা স্কুলে ক্লাস সেভেনে থাকতে এই ব্যাপারটি সে শিখেছিল।পুলিশের নিক্ষিপ্ত টিয়ার গ্যাসের সেল বিস্ফোরিত হওয়ার ঠিক আগে আগে ( কিংবা বিস্ফোরিত হওয়া মাত্র) একটা ভেজা রুমাল জড়িয়ে সেই সেলটি হাতে তুলে নিয়ে পুলিশের দিকে ছুড়ে মারার ব্যাপারে রেজাউলের তুলনা ছিল না।এই দূঃসাহসী কাজটি সিলেটে সে ই প্রথম চালু করেছিল বলে আমার ধারনা।

কাজটি সাংঘাতিক বিপদ জনক।এক সেকেন্ডের হেরফেরে গ্যাসের সেলটি হাতেই ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।তাছাড়া গ্যাসের সেল ছুড়ে মারার জন্য পুলিশের দিকে অনেক খানি ছুটে যাবার দরকার হয়।পুলিশের হাতে ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকে ষোল আনা। রেজাউলকে এ নিয়ে চিন্তিত হতে দেখিনি কোন দিন ।সংঘর্ষ বাধলেই আমরা মোটামুটি নিরাপদ দূরত্বে থেকে ঢিল ছোড়া শুরু করতাম,কিন্তু রেজাউল তার শার্ট খুলে কোমরে বেধে একেবারে সামনে এগিয়ে যেত।এ জন্যই আমাদের মতো স্কুল পড়ুয়া কিশোরদের কাছে রেজাউল ছিল হিরো।

দুই.

সেই হিরো রেজাউলের পরিনতি ছিল খুবই করূণ।এরশাদ সরকারের শেষ সময়ের কথা।সারা দেশ আন্দোলনে টালমাটাল।প্রতিদিন মিটিং মিছিলে আমাদের ছোট শহর সয়লাব।নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে সিলেটের জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মুকিত খানের বাসায় হামলা চালালো বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা।রেজাউল ছিল সেই বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতার সঙ্গী।মুকিত খানের বাসা রক্ষা করতে বেপরোয়া হয়ে উঠল পুলিশ। পুলিশের ছোড়া মূহর্ূমূহূ টিয়ার গ্যাস আর গুলির শব্দে সারা শহর প্রকম্পিত। দাড়িয়া পাড়া ছাড়িয়ে জল্লার পাড় হয়ে জিদ্দাবাজার পর্যন্ত সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লো ।অসংখ্য মানুষ আহত হলো।গ্রেফতার হলো প্রায় শতাধিক।

রেজাউলের হাতে গুলি লেগেছিল।জল্লার পাড়ের কালভার্টের ওপরে দাড়িয়ে থাকা রেজাউলের বাম হাতে এসে গুলিটি বিধে। গ্রেফতার এড়াতে কালভার্ট ডিঙিয়ে রেজাউল ঝাপ দেয় নিচে বয়ে যাওয়া আবর্জনা ভরা খালে ।সেই আবর্জনা ভরা খালে নাক ভাসিয়ে গুলিবিদ্ধ রেজাউল লুকিয়ে ছিল প্রায় দেড় ঘন্টা।তারপর অনেকখানি পথ সে আবর্জনা ঠেলে গার্লস স্কুলের পেছন দিক দিয়ে উঠে বাসায় চলে যায়।

রেজাউলের গুলি খাওয়ার খবর আমি পেয়েছিলাম কয়েকদিন পর।তখনকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল না ।এরশাদ সরকারের পতন হয়েছিল সপ্তাহ খানেকের মধ্যে।এ কয়দিন পুলিশের ভয়ে রেজাউলের ঠিক মতো চিকিৎসা হয়নি ।আর তাই তার হাতের অবস্থা ভাল নয় । রেজাউলের বাবা কী যেন একটা ছোট খাটো চাকরি করতেন।তিনি এবার তাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে এলেন ঢাকায় ।

রেজাউলের সাথে আমার আর দেখা হয় নি কোনদিন ।খবর পেয়েছিলাম চিকিৎসা শেষে সে তাদের নিজ জেলা টাঙ্গাইলের কোন এক গ্রামে চলে গিয়েছিল।ডাক্তাররা তার বাম হাতটি বাচাতে পারেননি।পচন ধরে ছিল হাতে।শেষ পর্যন্ত কনুইয়ের কাছে কেটে হাতটি বাদ দিতে হয়েছিল...।

তিন.
গত কয়েকদিন ধরে রেজাউলের কথা খুব মনে পড়ছে। তার সাথে আমার খুব একটা ঘনিষ্টতা না থাকলেও তাকে বন্ধু হিসেবে ছোটবেলা পেয়েছিলাম,সে স্মৃতি ভুলবার নয়।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ শুরু হয়েছে। ক্ষমতার লোভ যে কতো বিভৎস আর নীতিহীন হতে পারে তা দেখছি বসে বসে। আগামী নির্বাচনে, রাজনীতিতে মূমুর্ষ এরশাদের পলিটিক্যাল ক্যারিয়ারের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়া যেত । কিন্তু আমাদের মহান দুই নেত্রী সেই মৃতপ্রায় এরশাদকে যেভাবে টানাটানি শুরু করেছেন তা দেখে লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। এরশাদের বাসায় কে কার ছেলেকে আগে পাঠাবেন তা নিয়ে রীতিমতো হুড়োহুড়ি লেগে গেছে।সুযোগ পেয়ে এরশাদ সাহেবও এই বৃদ্ধ বয়েসে তারুণ্যের উদ্যম নিয়ে মাঠঘাট দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।

সমপ্রতি তিনি ঘোষনা দিয়েছেন যে, তার হাতে রক্তের দাগ নেই !শেখ হাসিনার লাশের স্পৃহায় নূর হোসেনকে প্রান দিতে হয়েছে!আর ডাক্তার মিলন মারা গেছেন ছাত্রদলের দুই গ্রুপের আভ্যন্তরীন কোন্দলে! কোন মহল থেকে তার এই বক্তৃতার কোন প্রতিবাদ আমার চোখে পড়েনি ।শেখ হাসিনা আর খালেদা জিয়া চুপচাপ থেকে হজম করে নিয়েছেন যে তারা পরোক্ষ ভাবে নূর হোসেন আর ডাক্তার মিলন হত্যার জন্য দায়ী!তবু দুজনের কেউই এরশাদকে বিগড়াতে চান না।এই ভন্ডকে নিজনিজ জোটে পাওয়ার জন্য তারা এতোটাই উদগ্রীব!






চার.
পটুয়া কামরুল হাসানের কথা পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে পড়ে।মৃতু্যর আগ মূহূর্তে তিনি স্কেচ বুকে একেছিলেন "দেশ আজ বিশ্ববেহায়ার কবলে।"আজ এরশাদকে নিয়ে এই র্নিলজ্জ দড়ি টানাটানি দেখলে তিনি স্কেচবুকে কোন বেহায়ার ছবি আকতেন জানতে খুব আগ্রহ হয়।

পাচ.
আমি একানব্বইর নির্বাচনে খালেদা জিয়ার দলকে ভোট দিয়েছিলাম।এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তার আপোষহীন ভুমিকা আমার মতো অসংখ্য তরুনকে অনুপ্রানিত করেছিল খালেদা জিয়াকে সমর্থন জানানোর জন্য।


আমি জানি না আগামী নির্বাচনে এরশাদের সাথে তার সংশ্লিষ্ঠতা খালেদা জিয়াকে আরো বেশী নতুন ভোটারের ভোট পেতে কী পরিমান সাহায্য করবে। আসলে রাজনীতি সম্পর্কে আমার জ্ঞান খুব একটা ভালো নয়। শুধু শিখেছি যে, রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই।আজ যা শেষ বলে মনে হয় কাল আবার তা ভালবাসা নিয়ে গজিয়ে ওঠে।যেমন গজিয়ে ওঠে টিকটিকির লেজ।

আহা,আমার বন্ধু রেজাউলের উচিত ছিল টিকটিকি হওয়া!এরশাদের সাথে সবার মাখামাখি দেখে এবার নিশ্চয়ই তারও হাত গজিয়ে উঠতো !আর তা হলে,কিশোর বয়েসের ভুল আন্দোলনের জন্য এরশাদের কাছে মাপ চাওয়ার দলে আমিও শরিক হতে পারতাম...।

সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১০ দুপুর ১:৫৯
৫০৯ বার পঠিত
১২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মাথা ঠান্ডা করুন, ভাবুন, যুক্তি দিয়ে পরিস্থিতি বিবেচনা করুন।

লিখেছেন জুল ভার্ন, ২৭ শে নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৩

মাথা ঠান্ডা করুন, ভাবুন, যুক্তি দিয়ে পরিস্থিতি বিবেচনা করুন।

নিজের মতকে যে একমাত্র সত্য, সঠিক ভাবে সে নিঃসন্দেহে ফ্যাসিস্ট। সাইকোপ্যাথ সে যে উন্মাদের মতো খিস্তি খেউর করে, নিজের ভয়াবহ পিশাচ আইডিয়া... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিন্দু - সনাতন - ইসকন কোনটা কী?

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৭ শে নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:১৪


হিন্দু আমার ভাই, হিন্দু আমার প্রতিবেশী। আমার প্রতিবেশীর সাথে আমাদের কোন ঝামেলা নাই, ৩৬শেও হয়নি। আমরা একসাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিজয় মিছিল দেখেছি, কেউ তাদের দিকে তাকায়নি, সবাই ঘটনা পর্যবেক্ষণ করছিল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসকন আর হিন্দু এক না; হিন্দুরা কেন ইসকনকে সমর্থন করছে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২৭ শে নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:২৪



সকল ধর্ম-বর্ণে শিশু বলাৎকার হলো নিষিদ্ধ।তারপরও ইসকন নেতা চিন্ময় প্রায় সময় শিশুদের সাথে বলাৎকার ও নারীদের সঙ্গে যৌন কাজে লিপ্ত থাকে।এটি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে তিনি এই কাজে লিপ্ত।... ...বাকিটুকু পড়ুন

=স্নিগ্ধ সকালে নিমন্তন্ন চায়ের=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৭ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:১৩



ঘুম রেখে এসো দখিনের বারান্দায়, কী স্নিগ্ধ আলো,
উড়ছে চিল উঁচু তলা ছুঁয়ে, লাগবে তোমারও ভালো,
চা করেছি, চুলায় জল করছে টগবগ, দিয়েছি চা পাতা
তুমি এলেই কাপে ঢালবো, খুলবো প্রেমের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারত বিরোধিতা ও ৮০০ কোটি টাকা গচ্ছা যাওয়ার কাহিনী!

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৭ শে নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:০০


"ভারত আমাদের শত্রু যে প্রজন্ম তা বুঝতে পারবে তারাই হবে শ্রেষ্ঠ প্রজন্ম"- মওলানা ভাসানী। জুলাই অভ্যুত্থানের পিছনে শেখ হাসিনা রেজিমের দুঃশাসন ও বিগত ২/৩ টি নির্বাচনে ভারতের নগ্ন হস্তক্ষেপ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×