১ম পর্বঃ বৌদ্ধরাই বাংলার আদিবাসী এবং গৌতম বুদ্ধ এই ধর্মটির প্রতিষ্ঠাতা নন শেষ প্রবক্তা
২য় পর্বঃ বৌদ্ধদের প্রতি বহিরাগত বর্ণ হিন্দুদের দৃষ্টিভঙ্গি
যেখানে বাংলার প্রায় সমস্ত জনগোষ্ঠী বৌদ্ধ ছিল সেখানে এখন বৌদ্ধদের খুঁজে পাওয়া দুস্কর। বৌদ্ধ বাংলা এখন হিন্দু বাংলা (পশ্চিমবঙ্গ) আর মুসলিম বাংলা (বাংলাদেশ) তে ভাগাভাগি হয়ে গেছে। বাংলা প্রথম হিন্দু শাসনাধীনে আসে উত্তর ভারতীয় গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়ে।গুপ্ত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয় চন্দ্র গুপ্তের মাধ্যমে ৩১৯-২০ খ্রিস্টাব্দে। এই গুপ্ত সাম্রাজ্যের সর্বাধিক বিস্তৃতি ঘটে সমুদ্র গুপ্তের শাসনামলে (৩৪০-৩৭৬ খ্রিস্টাব্দে)। অন্যদিকে বাংলা মুসলিম শাসনাধীনে আসে ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খিলজির মাধ্যমে।
ডক্টর মোহাম্মদ মোহর আলীর মতে উত্তরবঙ্গ এবং দক্ষিণ পশ্চিম বাংলার অংশবিশেষ গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এলাহাবাদে প্রাপ্ত শিলালিপিতে সমতট (বাংলার পূর্বাঞ্চল) কে সমুদ্র গুপ্তের সাম্রাজ্যের সীমান্তবর্তী একটি রাজ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ড. নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন একমাত্র সমতট ছাড়া বাংলার প্রায় সমস্ত জনপদ গুপ্ত সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল (ড. নীহাররঞ্জন রায়: বাঙালির ইতিহাস আদিপর্ব, পৃষ্ঠা: ৬৯)। ড. নীহাররঞ্জন আরো বলেন ‘বাংলাদেশের অধিকাংশ জনপদ গুপ্ত সাম্রাজ্যের দখলে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি সমাজ উত্তর-ভারতীয় আর্য-ব্রাহ্মণ্য বর্ণ ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হতে আরম্ভ করে। পঞ্চম শতকে দেখা যায় উত্তর বঙ্গে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম স্বীকৃতি লাভ করেছে, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের দেবদেবীর পূজা করা হচ্ছে, ব্রাহ্মণদের বসবাস ক্রমেই বাড়ছে। অব্রাহ্মনেরা ব্রাহ্মণদের জমি দিচ্ছে, অযোধ্যাবাসী ভিন প্রদেশে এসেও এদেশে মন্দির সংস্কারের জন্য জমি কিনছে। উত্তর-পূর্ব বাংলায় ষষ্ঠ শতকের গোড়াতেই পুরোদস্তুর ব্রাহ্মণ সমাজ গড়ে উঠে (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা:৫৪)।
নীহাররঞ্জন রায়ের বর্ণনা মতে তৃতীয়-চতুর্থ শতক পর্যন্ত বাংলাদেশে আর্য-বৈদিক হিন্দু ধর্মের ও সংস্কৃতির কিছুই প্রসার হয়নি। ষষ্ঠ শতকের আগে বঙ্গ বা বাংলার দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ঢুকতেই পারেনি। অথচ গুপ্ত সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক বন্ধনে বাধা পড়ে বাংলাদেশেও সর্বভারতীয় (ব্রাহ্মণ্য) ধর্ম ও সংস্কৃতির স্রোত সবেগে আছড়ে পড়লে বাংলাদেশের নানা জায়গায় ব্রাহ্মণরা এসে স্থায়ী বাসিন্দা হতে থাকলেন (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা:১৩২)।
রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে বা তার কাছাকাছি সময়ে আর্যরা বাংলায় আসে। এসময় যুদ্ধযাত্রা, বাণিজ্য ও ধর্ম প্রচার উপলক্ষে ক্রমশ বহু আর্য এদেশে বাস করতে শুরু করে। কিন্তু এখানে তাদের প্রভাব প্রতিষ্ঠা করতে আরো কয়েক শ’ বছর লেগে যায়। বাংলায় আর্য-প্রভাব দৃঢ় হয় পাঁচ ও ছয় শতকে গুপ্ত আমলে (রমেশচন্দ্র মজুমদার: বাংলাদেশের ইতিহাস, প্রাচীন যুগ, ষষ্ঠ সংস্করণ, পৃষ্ঠা ১৬)।
ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের মতে জৈন ও বৌদ্ধধর্মের বন্যায় পূর্ব্ব ভারত ভাসিয়া গিয়াছিল, সুতরাং ব্রাহ্মণেরা এই দেশকে তাহাদের গন্ডির বহির্ভূত করিতে চেষ্টিত হইয়াছিলেন। ‘যাহারা তীর্থ যাত্রার উপলক্ষ ভিন্ন এই সকল দেশে গমন করিবেন তাঁহাদিগকে প্রায়শ্চিত্ত করিয়া স্বদেশে ফিরিবার অধিকার লাভ করিতে হইবে’ ( বৃহৎ বঙ্গ, পৃষ্ঠা:৬)।
তাহলে আমরা যদি সবগুলো মতকে সমন্বয়ের চেষ্টা করি তাহলে দেখবো বাংলা-বিহারে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের ব্যপক প্রভাব ছিল সে কারণে ব্রাহ্মণেরা এই অঞ্চলে ধর্মীয় উদ্দেশ্য ছাড়া হিন্দুদের আগমনকে উৎসাহিত করেনি। কিন্তু বাংলা যখন উত্তর ভারতীয় গুপ্ত সাম্রাজ্যের দখলে চলে যায় তখন এই অঞ্চলে হিন্দুদের আগমন এবং প্রভাব বিস্তার বাড়তে থাকে। বিশেষ করে ৩৪০-৫০০ খ্রিস্টাব্দ এই সময়টাকে বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মের গোড়া পত্তনের সময় বলা যায়। আর স্থানীয় বৌদ্ধ-জৈন জনগোষ্ঠী হিন্দুদের এই আগমনকে সব সময় প্রতিরোধের চেষ্টা করেছে।
একটা বিষয় আমাদের কাছে পরিষ্কার থাকা দরকার যে খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের সমসাময়িক সময়কাল থেকে ব্রাহ্মণদের আগমন শুরু হলেও এবং খ্রিস্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতকে বাংলা উত্তর ভারতীয় গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীনস্ত হওয়ার ফলে হিন্দুরা বাংলা শাসনের সুযোগ পেলেও বাংলার মেজরিটি মানুষ কখনো হিন্দু ধর্মালম্বী হয়নি। এখনো দুই বাংলাকে ঐক্যবদ্ধভাবে বিবেচনা করলে হিন্দুরা মোট জনসংখ্যার ৪০% এর বেশি নয়। বর্তমান সময়ের মত সেই সময়েও হিন্দুদের খুঁটির জোর ছিল উত্তরভারত-দিল্লি অঞ্চল।
বাংলাদেশে হিন্দুদের আগমনের ঠিক কিছু আগে বৌদ্ধধর্মে বিভক্তি দেখা দেয়। একটা অংশের নাম হয় মহাজনী বৌদ্ধ অপর অংশের নাম হয় হীনযানী বা থেরাবাদী বৌদ্ধ। মহাজনী বৌদ্ধদের সাথে ব্রাহ্মণদের (হিন্দুদের) সুসম্পর্ক ছিল। মহাজনী বৌদ্ধদের মাধ্যমেই মূলত বৌদ্ধ ধর্মের বিকৃতি ঘটে-মূর্তি পূজার প্রচলন ঘটে। বৌদ্ধরা ব্রাহ্মণদের অত্যাচারে যেমন দুর্বল হয়েছে তেমনি দুর্বল হয়েছে নিজেদের ভিতরের বিভাজন-নিজেদের কালচারের ব্রাহ্মণায়নের ফলে।
খ্রীষ্টিয় প্রথম শতাব্দীতে কুশান সম্রাট কণিষ্কের রাজত্বকালে বৌদ্ধদের এক মহাসম্মেলনে বৌদ্ধ ধর্ম দু’টি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়।নাগার্জুন নামক প্রসিদ্ধ বৌদ্ধাচার্য কতকগুলি হিন্দু ও নতুন দেবদেবী স্বীকার করে এক ‘উদার’ বৌদ্ধমতের প্রবর্তন করেন। তা-ই হলো মহাজনী ধর্ম। আর প্রাচীন অর্থাৎ বুদ্ধদেবের প্রচারিত মতে যারা বিশ্বাসবান থাকলেন তাঁরা হীনযান সম্প্রদায়ভুক্ত হলেন। একে প্রাচীন বা স্থবির মতও বলে (সতীশচন্দ্র মিত্র, যশোর খুলনার ইতিহাস, উদৃত মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান, বাংলা ও বাঙালীঃ মুক্তি সংগ্রামের মূলধারা, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি, চতুর্থ সংস্করণ, ২০০৯ পৃঃ৩১ )
ড. আব্দুল মু’মিন চৌধুরী তাঁর Rise and Fall of Buddhism in South Asia গ্রন্থে উল্লেখ করেন;
নাগার্জুন -মহাজনী বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা-মূলত ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি বৌদ্ধ ধর্মে নিজেকে কনভার্ট করেন এবং পরবর্তীতে ব্রাহ্মণদের নানা দেব-দেবীকে মহাজনী বৌদ্ধ সম্প্রদায়ে চালু করে দেন।আশওয়াঘোষ নামে আরেক প্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণ নিজ ধর্ম ত্যাগ করে মহাজনী বনে যান এবং ‘বুদ্ধাচরিত’ লিখেন যেখানে তিনি গৌতম বুদ্ধকে আর্য-ক্ষত্রিয় হিসেবে চিত্রায়িত করেন। ভিদু নামক এক ব্রাহ্মণ মহাজনী সম্প্রদায়ের বই-পুস্তকগুলি ১ হাজার কপি করে সেগুলোকে পাটালিপুত্রে (বিহারে) বিতরণ করেন, আরেক ব্রাহ্মণ কলিকা মহাজনী সম্প্রদায়কে সৌরাষ্ট্রে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করেন। তিনি তার দুই ব্রাহ্মণ ভাই শংকরপতি এবং মুদগ্রা গোমিনকে জানান মহাজনী বৌদ্ধে জয়েন করা মহাদেব (শিব) এর নির্দেশ (পৃষ্ঠা ১৭৭-১৭৮)।
অর্থাৎ বৌদ্ধদের সাথে কুলিয়ে উঠতে না পেরে ভিতর থেকে বৌদ্ধদেরকে দুর্বল করার জন্য, বৌদ্ধদেরকে ব্রাহ্মণায়ন এর দিকে নিয়ে আসার জন্য মহাজনী সম্প্রদায়ের যাত্রা শুরু হয়।মহাজনী বৌদ্ধ সম্প্রদায় চালু করে বৌদ্ধদেরকে ধর্মীয় ও কালচারাল দিকে দুর্বল করার ব্যবস্থা করা হয়।
একই ফর্মুলা আমরা দেখতে পাই আমাদের বর্তমান বাংলাদেশেও। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে বাঙালি আইডেন্টিটিতে বিশ্বাসী এবং মুসলিম আইডেন্টিটিতে বিশ্বাসী দুইটা গ্রুপ ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে।বাঙালী আইডেন্টিতে বিশ্বাসীদের বয়ান হচ্ছে বাঙালী হতে হলে ধর্মীয় পরিচয় বাদ দিতে হবে অন্যথায় পুরোপুরি বাঙালী হওয়া যাবেনা। অথচ ১৯৪৭ সালের পুর্বে বাঙ্গালী ও মুসলিম পরিচয় নিয়ে এমন কোন দ্বন্ধ ছিলনা। বাঙালি আইডেন্টিটিতে বিশ্বাসীরা বাঙ্গালীয়ানার নামে কালচারের রবীন্দ্রায়ন করতে শুরু করে।(পড়ুন বিস্তারিতঃ বাংলাদেশে কালচারের রবীন্দ্রায়ন ও আমাদের স্যাকুলারিটি)। এরই ধারাবাহিকতায় পহেলা বৈশাখে মঙ্গল প্রদীপ, মঙ্গল শোভাযাত্রা ইত্যাদি হিন্দু ধর্মের নানা প্রতীক ব্যবহার করে কালচারের হিন্দুয়ায়ন করার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠছে। একই ভাবে পাঠ্যপুস্তকেও হিন্দু ধর্মীয় শব্দ, চিহ্ন, কন্টেন্ট বাড়িয়ে মুসলিম ছেলে-মেয়েদেরকে কালচারালি বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চলতেছে যা স্বাভাবিকভাবে সংখ্যাগুরু মুসলমানদেরকে সংক্ষুব্ধ করছে।
মূলত গুপ্তদের সময়ই হচ্ছে বাংলায় ব্রাহ্মণায়নের সূচনা, হিন্দুধর্মের গোড়াপত্তনের সময়। গুপ্তদের সময় থেকে ব্রাহ্মণদেরকে ভারতের নানা অঞ্চল থেকে এনে বাংলায় বসতি গড়ার সুযোগ করে দেয়া হয়। ব্রাহ্মণদেরকে নিজেদের বাইরে বিয়ে না করতে বলা হয়। নিজেদের মধ্যে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত রাখতে এই সময় থেকে বর্ণ প্রথা (Caste System) কে বেশ গুরুত্ব দেয়া হয়। গুপ্ত শাসনামলে ব্রাহ্মণায়নের জন্য সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কিছু কিছু ইন্ডিয়ান ঐতিহাসিক গুপ্ত শাসনামলকে উত্তর ভারতে অসুর বিজয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উপর ব্রাহ্মণদের বিজয়। আর এই বিজয় উত্তর ভারত থেকে বাংলার কিছু অংশে পর্যন্ত গড়িয়েছে।
(চলবে)
সংগৃহীতঃ মূলধারা বাংলাদেশ
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১৬ রাত ১২:২০