বৌদ্ধরাই বাংলার আদিবাসী এবং গৌতম বুদ্ধ এই ধর্মটির প্রতিষ্ঠাতা নন শেষ প্রবক্তা
বৌদ্ধরা কিভাবে বাংলা থেকে হারিয়ে গেলো সে বিষয়ে আলোচনা শুরুর আগে আমরা দেখতে চাই বৌদ্ধদের প্রতি বহিরাগত আর্যদের (উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের)দৃষ্টিভঙ্গি কি ছিল এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠী বৌদ্ধরা বঙ্গদেশে ব্রাহ্মণদের আগমনকে কিভাবে নিয়েছিল।
‘ঐতরেয় ব্রাহ্মনে’ ভারতবর্ষ অথবা আর্যভূমি অথবা আর্যজাতির বসতি বিস্তারের এই সীমা নির্ধারণ করিয়া দিলে, তাঁহার পরই ‘ঐতরেয় আরণ্যক’ বলিলেন যে বঙ্গ-বগধ-চেরজাতি পক্ষীবিশেষ; উহাদের ধর্ম নাই, উহারা নরকগামী হইবে।ইহার মোটামুটি অর্থ এই হইলো যে, আর্যগণ এলাহাবাদ পর্যন্ত আসিয়াছিলেন, তাহার ওদিকেই বঙ্গ-বগধ-চেরজাতি।ইহারা আর্যগণের শত্রু।আর্যগণের বসতি বিস্তারে বাধা দিত।তাই আর্যগণ ইহাদিগকে দেখিতে পারিতেন না।যাহাদিগকে তাঁহারা দেখিতে পারিতেন না, তাহাদিগকে মানুষ না বলিয়া পশু পক্ষী রাক্ষস বলা তাঁহাদের রোগ ছিল।তামিলগন তাঁহাদের কাছে বানর, কর্ণাটগণ হয়তো ভালুক, লঙ্কার লোক রাক্ষস।সেইরূপ বাংলার লোক পাখি(হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, বৌদ্ধধর্ম, পৃষ্ঠা ৩৬)।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে হিন্দুদের আগমনের আগে থেকেই এই অঞ্চলে-বাংলা (বঙ্গ), বিহারে (মগধ) বৌদ্ধদের বসবাস ছিল এবং তারা আর্য তথা হিন্দু-ব্রাহ্মণদের আগমনকে-দখলদারিত্বকে ভালোভাবে নেয়নি বরং প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল।আর সেই প্রতিরোধ গড়ে তোলার কারণে বাংলার লোকেরা আর্য-ব্রাহ্মণদের কাছে পাখি হিসেবে বিবেচিত হত। ‘উত্তরাপথের পশ্চিমাংশ আর্যগণ কর্তৃক বিজিত হইবার বহুকাল পরেও মগধ ও বঙ্গ স্বাধীন ছিল'(রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়, বাঙ্গলার আদিম অধিবাসী ও আর্যবিজয়, পৃষ্ঠাঃ২৯, উদৃত বঙ্গদর্পন)।
অর্থাৎ আর্য-ব্রাহ্মণরা ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম এলাকা প্রথমে দখল করেন, সেই দখলদারিত্বের অনেক পরেও পূর্ব অঞ্চল বিশেষত বাংলা-বিহার স্বাধীন ছিল।মূলত আর্য-ব্রাহ্মণরা শুরুতে পাঞ্জাব অঞ্চল দখল করে, তারপর ক্রমান্বয়ে পূর্বদিকে আসে।
বাংলা এবং বিহারের মানুষ বৌদ্ধ ধর্মালম্বী হলেও বৌদ্ধদের সংখ্যাধিক্য অনেক অনেক বেশি ছিল পূর্ববঙ্গ তথা বর্তমান বাংলাদেশে।এ কারণে হিন্দুরা গঙ্গা জলকে পবিত্র মনে করলেও গঙ্গার যে সব শাখা-প্রশাখা বাংলাদেশে এসেছে সেসব শাখা নদীর পানিকে বৌদ্ধ সংস্পর্শের কারণে দূষিত মনে করতো।
‘গঙ্গা শুধু তাঁহার স্বীয় উপকূল নহে, চতুষ্পার্শ্বথ সমস্ত জন-বিরল স্থানে আর্য্যসমাজকে আহবান করিয়া আনিয়াছেন।এইজন্য কালীঘাটের মরাগঙ্গার কর্দ্দম-জলে অবগাহন করিবার জন্য নিত্য শত শত লোকের ভিড় হয়।অথচ এককালে যে সকল নদী গঙ্গার প্রধান শাখা ছিল, ব্রাহ্মণগণ বৌদ্ধাধিকারে দূষিত মনে করিয়া যাহাদের মহিমা লুপ্ত করিয়া দিয়েছেন-পূর্ব্ববঙ্গের সেইরূপ বড়ো বড়ো নদীর এখন আর আদর নাই(দীনেশ চন্দ্র সেন,বৃহৎ বঙ্গ, পৃষ্ঠাঃ ৪)।
বৌদ্ধদের প্রতি ব্রাহ্মণ বিদ্ধেষের আরেকটা নমুনা হচ্ছে বৌদ্ধদেরকে ‘বুদ্ধু’ বলে ডাকা, যেই শব্দটি এখনো ‘বেকুব বা বোকা’ অর্থে প্রচলিত আছে আমাদের দেশে (M. Abdul Mu’min Chowdhury, The Rise and Fall of Buddhism in South Asia, London, 2008, পৃষ্ঠা ৩১০)।
‘বৌদ্ধবিহারের নাম শুনিলে হিন্দুরা কানে আঙ্গুল দিতেন, এই পাপ নাম উচ্চারণ করিতে নাই-শিশুরা এই শিক্ষা পাইয়াছিল’। কুমিল্লা জেলার কামতা নামে একটি গ্রামে বৌদ্ধদের একটা সংঘ ছিল।হিন্দুরা এই গ্রামের নাম মুখে লইতো না।’পার্শ্ববর্তী গ্রামবাসীগণ কখনও ভোরের বেলায় সেই গ্রামের নাম লয় না, পুবের গ্রাম কি পশ্চিমের গ্রাম ইত্যাদি বলিয়া দরকার হইলে ইহার উল্লেখ করিয়া থাকে’ (দীনেশ চন্দ্র সেন, বৃহৎ বঙ্গ, পৃষ্ঠা ৭)।
ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের মতে ‘বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি ব্রাহ্মণেরা এতই বিদ্বিষ্ট হইয়াছিলেন যে, সেই সকল পাপ-কথা যেন কেহ না শুনে এই উদ্দেশ্যে ব্রাহ্মণেরা ইচ্ছা করিয়া তাঁহাদের কীর্তি লোপ করিয়া দিয়েছিলেন’ (প্রাগুক্তঃ পৃষ্ঠা ৯)।হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘যে জনপদে এক কোটির অধিক বৌদ্ধ এবং ১১৫০০ ভিক্ষু বাস করিত, সেখানে একখানি বৌদ্ধ গ্রন্থ ৩০ বৎসরের চেষ্টায় পাওয়া যায় নাই’ (উদৃত, দীনেশ চন্দ্র সেন, বৃহৎ বঙ্গ, পৃষ্ঠা-১১)।
এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা দরকার ব্রিটিশ শাসনামলের একটা দুর্ভিক্ষে (১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে) এক কোটি লোক মারা যায়,বলা হয় বাংলার এক তৃতীয়াংশ জনসংখ্যাই সেসময় মারা যায়।অর্থাৎ মোট জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৩ কোটি। আর এখানে যেই সময়টা আমরা আলোচনা করতেছি সেই সময়টা হচ্ছে বাংলায় মুসলমানদের আগমনের আগের সময়টা অর্থাৎ, ১২০৪ খ্রিস্টাব্দের আগের সময়।সেই সময় বাংলার মোট জনসংখ্যা হয়তো এক কোটি থেকে কিছুটা বেশি ছিল আর হরপ্রসাদ শাস্রী বলেছেন এক কোটির উপরে বৌদ্ধ ছিল। যেহেতু সেই সময় কোনো আদমশুমারি ছিল না, ফলে সংখ্যাগুলো সম্ভাব্য সংখ্যা; কিন্তু একটা বিষয় পরিষ্কার সেসময়ে বাংলার প্রায় সব মানুষ বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিল।
চীনা পরিব্রাজক ফাহিয়েন ৩৯৯-৪০৪ খ্রিস্টাব্দে ভারত সফর করেন।তিনি দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার তাম্রলিপির (তমলুক) মধ্য দিয়ে সফর করেন।এসময় তিনি বৌদ্ধ ধর্মকে এ এলাকার সর্বাধিক প্রভাশালী ধর্ম হিসেবে দেখতে পান (মোহর আলী, হিস্ট্রি অব দি মুসলিমস অব বেঙ্গল, পৃষ্ঠা ৭)।
বাংলাদেশে আজ থেকে ২৫/৩০ বছর আগেও মানুষ মাটিতে বিছানা করে ঘুমাতো বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে এটা বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবেই হয়েছে। ‘বৌদ্ধ-ভিক্ষুগণ উচ্চাসন মহাসন ত্যাগ করিতেন।হিন্দুস্থানে পাঞ্জাবে এমনকি ভারতবর্ষের সব দেশেই খাটিয়ার উপর শোয়।মাটিতে শুইতে তাহাদের বড়োই কষ্ট হয়, পারতপক্ষে তাহারা মাটিতে শোয় না।কিন্তু বাংলায় তাহার বিপরীত’ (হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, বৌদ্ধধর্ম, পৃষ্ঠা ৩৮)।
কি ভীষণ অত্যাচারের সহিত ব্রাহ্মণেরা বৌদ্ধ ও জৈনধর্ম্ম ভারত হইতে নির্মূল করিতে চেষ্টা পাইয়াছিলেন, তাহা শঙ্কর-বিজয় নামক পুস্তকের নিম্নলিখিত কথাগুলি পাঠ করিয়া বুঝিতে পারা যায়: ‘দুষ্টমতাবলম্বিন: বৌদ্ধান জৈনান অসংখ্যাতান রাজমুখ্যাননেকবিদ্যা-প্রসঙ্গভেদৈর্নির্জিত্য তেষাং শিরাংসি পরশুভিশ্ছিত্ত্বা বহুষু উদুখলেষু নিক্ষিপ্য কঠভ্রমণৈশ্চূ র্ণীকৃত্য চৈবং দুষ্টমতধ্বংসমাচরন নির্ভয়ো বর্ত্ততে’। বৌদ্ধধর্মের নেতারাই শুধু এই ভাবে নিপীড়িত হন নাই, শূন্যপুরানে দেখা যায় অতি নিম্নস্তরের বিকৃত বৌদ্ধ ধর্মমতালম্বীরা পর্যন্ত ব্রাহ্মণদের ভয়ে আতংকিত হইয়াছিল(দীনেশ চন্দ্র সেন,বৃহৎ বঙ্গ, পৃষ্ঠা ৯)
আর্য-হিন্দুদের বসতি বিস্তারে বাধা দিয়ে স্থানীয় বৌদ্ধরা শুধু আর্য-হিন্দুদের ঘৃণা-বিদ্ধেষেরই স্বীকার হন নাই, বৌদ্ধ ধর্মটাই বাংলা থেকে ধীরে ধীরে গায়েব হয়ে গেলো।
দুই ধর্মের নীতিগত দ্বন্ধ
বৌদ্ধ অধ্যুষিত বাংলাতে হিন্দুদের আগমন এবং বসতি বিস্তারকে কেন্দ্র করে যেমন বৌদ্ধ-হিন্দু বিরোধের সূচনা হয়েছে একইসাথে হিন্দুদের ধর্মীয় বিষয়ের সাথেও বৌদ্ধদের বিরোধ শুরু হয়েছিল।
মহাভারতকার লিখিয়াছেন-ব্রাহ্মণের সেবা করিলে ইহলোক ও পরলোক এমন কোনো অভীপ্সিত সামগ্রী নাই, যাহা মানুষে না পাইতে পারে। এখানে বৌদ্ধধর্ম জোর দিয়া বলিল ‘কাহাকেও কিছু দিবার ক্ষমতা অপরের নাই।কম্মই লোকের অদৃষ্ট নির্ম্মাণ করে এবং কর্ম্মই সর্ব্বফলপ্রসূ’। মহাভারতের অনুশাসন পর্ব্বে ব্রাহ্মণ সম্বন্ধে যে সকল প্রশংসাবাদ আছে তাহার কিছু আমরা নিম্নে দিতেছি:
ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলিতেছেন, ‘ফলত ব্রাহ্মণ প্রীতি অপেক্ষা উৎকৃষ্ট আর কিছুই নাই, আমি ব্রাহ্মনগণের দাস। এই জীবলোকে স্ত্রীজাতির যেমন পতিই পরমধর্ম্ম, পতিই দেবতা ও পতিই পরমগতি, সেইরূপ ক্ষত্রিয়কুলের ব্রাহ্মণসেবাই পরম ধর্ম্ম, ব্রাহ্মণই পরম দেবতা ও পরমগতি (অষ্টম অধ্যায়)।
ব্রাহ্মণেরা পিতৃ, দেবতা, মনুষ্য ও উরোগগণের পূজ্য।উহারা দেবতাকে অপদেবতা ও অপদেবতাকে দেবতা করিয়া থাকেন।মুষ্টিদ্বারা বায়ুগ্রহন ও হস্তদ্বারা চন্দ্রস্পর্শ ও পৃথিবীধারণ যেরূপ, ব্রাহ্মণকে পরাজয় করাও তদ্রুপ সুকঠিন’ (৩৩ অধ্যায়)।
ব্রাহ্মণকে কি কি খাওয়াইলে বা দিলে স্বর্গলাভ হয়, ৬৪ অধ্যায়ে তার একটি দীর্ঘ তালিকা আছে। যে ব্রাহ্মণ বিদ্যাশূন্য, তিনিও অন্যকে পবিত্র করিতে পারেন।ফলত ব্রাহ্মণ বিদ্ধান হউন বা মূর্খ্য হউন–তাঁহাকে পরম দেবতাস্বরূপ জ্ঞান করা বিধেয়।
ব্রাহ্মণই সর্ব্বপ্রধান, তাঁহা হইতে শ্রেষ্ঠ আর কেহ নাই।চন্দ্র, সূর্য্য, জল, বায়ু, ভূমি, আকাশ ও দিক-সমূহ ব্রাহ্মণ-শরীরে প্রবিষ্ট হইয়া অন্য গ্রহণ করিয়া থাকেন (৩৪ অধ্যায়) (উদৃত; ড. দীনেশ চন্দ্র সেন,বৃহৎ বঙ্গ, পৃষ্ঠা ৪৭-৪৮)
স্থানীয় বাঙালি বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী আর্য-ব্রাহ্মণদের এসব শ্রেষ্ঠত্বের দাবি-দাওয়াকে কখনো মেনে নেয়নি।ফলে দ্বন্ধ-সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠে।
অথর্ব ভেদ অনুযায়ী একজন ব্রাহ্মনের যে কোনো মহিলার উপর অধিকার রয়েছে এমনকি বিবাহিত হলেও।কোনো মহিলার যদি দশজন স্বামী থাকে আর তাদের মধ্যে কোনো ব্রাহ্মণ না থাকে সেক্ষেত্রে কোনো ব্রাহ্মণ যদি সেই মহিলাকে গ্রহণ করতে চায়, সেই মহিলার হাত ধরে, তাহলে সেই ব্রাহ্মণই সেই মহিলার একমাত্র স্বামী হয়ে যায় (M. Abdul Mu’min Chowdhury, The Rise and Fall of Buddhism in South Asia, London, 2008,পৃষ্ঠা ১০৪-১০৫)।
ঐতরেয় ব্রাহ্মন অনুযায়ী যদি কোনো ব্রাহ্মণের সাথে অব্রাহ্মণের কোনো বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দেয় সেক্ষেত্রে ব্রাহ্মনকেই সঠিক হিসেবে ধরে নেয়া উচিত (প্রাগুক্ত,পৃষ্ঠা-১০৮)।
ব্রাহ্মণদের এসব মতবাদকে-নিজেদেরকে সুপিরিয়র দাবি করে দেবতার আসনে বসিয়ে অন্যকে ছোট করে দেখা-অন্যকে অধীনস্ত করার চেষ্টাকে বৌদ্ধরা সব সময়ই প্রত্যাখান করেছিল। শেষ পর্যন্ত ব্রাহ্মণরা যখন বাংলার রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতে পেয়েছিলো তখন বৌদ্ধদেরকে তার মূল্য দিতে হয়েছিল।
সংগৃহীতঃ মূলধারা বাংলাদেশ
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই আগস্ট, ২০১৬ রাত ৯:২৬