আগের পর্বের লিংকঃ শ্যামদেশে কয়দিনঃ পর্ব তিনঃ আন্দামান সাগরে দ্বীপ যাত্রা
সেই ভোর সকাল থেকেই মহা ফাঁপরে আছি!
সকল প্রস্তুতি নিয়ে হোটেলের অভ্যর্থনা কক্ষে বসে আছি কিন্তু ট্যুর কোম্পানীর গাড়ীর কোন খবর নাই। সকাল ৭ টায় গাড়ী আসার কথা থাকলেও প্রায় ঘণ্টাখানেক পার হয়ে গেলেও তাদের কোন পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না। স্ত্রী এমনিতেই আমার বেশীরভাগ কাজকর্মের ব্যাপারে বরাবরই সন্দেহ প্রকাশ করে! এই ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম হয় না

: এই টিকিট কি তুমি নিজে কিনেছ?
: জ্বী, (আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করি) কেন তোমাদের এই খানে কি এইগুলো নিয়া দুই নম্বরি হয় নাকি?
: (সে আমার কথার উত্তর না দিয়েই আবার জিজ্ঞাসা করে) কোথা থেকে কিনছ?
: (আমি বলি) পাথুনাম মার্কেটের পাশে এদের অফিস থেকে কিনেছি।
: (সে আবার বলে) ওরা তো ফোন ধরছে না।
: (আমার উত্তর) ফোনতো নাই ধরতে পারে, আজ রবিবার তোমাদের সাপ্তাহিক বন্ধ (মনে করিয়ে দিয়ে যথেষ্ঠ প্রীত হই)।
: (সে আবার বলে) সমস্যা তো ওইটা না, ফোন বলছে এই নম্বরটা এখন আর ব্যবহৃত হচ্ছে না।
: (আমি বলি) খাইছে.........!!! তাইলে ক্যামনে কি?

: (সে আবার বলল) দুঃখিত, কি বললা বুঝলাম না
: (আমি আবার খাঁটি বাংলায় বললাম) ক্যামনে কি?
ইতিমধ্যে স্ত্রীও কাউন্টারের পাশে চলে এসে আমাদের কথোপকথন শোনে এবং যথারীতি আমার দিকে আরোও সরু চোখে তাকায়, ভাবটা এই রকম যে তার ধারণাই সত্যি আমি বিশাল ধরা খাইছি, ভুয়া কোম্পানীর টিকিট কিনেছি। আমি তার সাথে কোনরূপ বাদানুবাদে না গিয়ে হোটেল লবিতে গাছ আর ফুলের ছবি তুলতে এমন ভাবে ব্যস্ত হয়ে যাই যে আমার ছবি তোলার মনযোগ আর ভাব দেখলে যে কেউই আমাকে বড়সড় কোন ফোটুরের একটা সনদ হাতে ধরিয়ে দেবে



আজকে সারাদিন আমরা ব্যাংকক থেকে ‘রাতচাবুড়ী’ নামে প্রদেশে যাব এতকাল ছবি বা তথ্যচিত্রে দেখা থাইল্যান্ডের বিখ্যাত ভাসমান বাজার দেখতে আর মওকা পেলে টুক-টাক সওদা-পাতি করব এবং সেখান থেকে আবার ‘কাঞ্চনবুড়ী’ প্রদেশের বিখ্যাত ‘কাওয়াই নদীর ব্রীজ’ দেখতে যাবার কথাও আছে। কিন্তু সকাল বেলায়ই ট্যুর কোম্পানীর এই হেন ক্যাঁচালে আমাদের সেই আশা কচুপাতার পানির মত টলমল করতে থাকে।
গত কয়েক দিনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি এখানের সব কিছুই মোটামুটি সময় মত হতে, কোথায়ও তেমন কোন বিরক্তিকর অপেক্ষা করতে হয় নাই এই জন্য আজ সকালের এই অনির্ধারিত অপেক্ষা আমার কাছে বেশ খটকা লাগে। যাই হোক সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে নয়টার দিকে ট্যুর কোম্পানির গাড়ী আসে। গাড়ীতে আরোহণ করে ড্রাইভার কে কঠিন কিছু কথা বলার প্রস্তুতি নিতে না নিতেই হবু সহ-যাত্রীদের কয়েকজন তাদের কারণেই এই দেরী আর বিষয়টার দায়-দ্বায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নিয়ে ব্যাপক দুঃখ প্রকাশ করতে থাকে আর ধৈর্যশীল জাতির প্রতিনিধি হিসাবে ‘নো প্রব্লেম’ আর ‘ইট’স অলরাইট’ বলতে বলতে অপেক্ষা করার তিক্ততা হজম করি। ইতি মধ্যেই এই সহযাত্রীদের সাথে পরিচয় হয় তার সুদূর মেক্সিকো থেকে এসেছে আবারও তারা দুঃখ প্রকাশ করতে করতে আমাদের কে চকলেট আর চুইংগাম অফার করে।
ব্যাংককের রাজপথের সপ্তাহান্তের যথেষ্ট রিল্যাক্সড ভিড়ে আমরা আপাত-গন্তব্যে আগাতে থাকি। কিছুক্ষনের মধ্যে ‘চাও প্রাইয়া’ নদীর সুন্দর ব্রীজ অতিক্রম করে আমাদের ভ্যান একটা সার্ভিস স্টেশনে দাঁড়ায়। ভ্রমণ কোম্পানীর গাইড এসে আমদেরকে ভ্রমণের ধরনের উপর নির্ভর করে যথারীতি গায়ে স্টিকার লাগিয়ে দিয়ে যায়। গাড়ীর রিফুয়েলিং শেষ হলে আমরা আবার রওনা দেই। ইতিমধ্যে তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা আগের গাড়ী বদলিয়ে আমাদের গায়ে আর গাড়ীতে লাগানো স্টিকার মিলিয়ে আরেকটা গাড়ীতে উঠেছি। বেশ অভিনব ব্যবস্থা বেশী কথাবর্তার দরকার নেই সব কিছুই স্টিকার মিলিয়ে করতে হবে


সুন্দর সাজানো আর সোজা টানা হাইওয়ে ধরে বেশ গতির সাথে আমাদের গাড়ী ছুটে চলছে। মাঝে মাঝেই ছোট-খাটো বাজার বা গঞ্জ পাড় হচ্ছি।কিন্তু লোকজনের দেখা পাচ্ছি খুবই কম। কোথায় যেন পড়েছিলাম থাইল্যান্ডের অর্ধেকের বেশী লোক নাকি ব্যাংককে থাকে, বিষয়টা মনে হয় সত্যিই ব্যাংককের বাইরে এসে খুব কম লোকজনের দেখ মিলছে আর লোকালয়ের সংখ্যাও বেশ কম। রাস্তার দুই পাশে শুধু কৃষি জমি। কিছুক্ষন পরে আমরা কৃষি নির্ভর এমন এলাকার মধ্যে এসে উপস্থিত হলাম যেদিকে তাকাই শুধু বিভিন্ন ধরণের ফলের বাগান। বাগানের পর বাগান আম, আবার কখনো নারকেলের বাগান এগুলো ছাড়া পেয়ারা, পেপে, স্টবেরি, ড্রাগন ফ্রুট, জাম্বুরা, লেবু ইত্যাদি ফলের বাগান। দেখতে খুবই সুন্দর লাগছে, ইচ্ছে হচ্ছিল যে গাড়ী থামিয়ে দৌরে কোন একটা বাগানে ঢুকে যাই। এতও বড় বড় বাগান দেখলেও যাথারীতি লোকজনের দেখা পাচ্ছিলাম না, কি ভাবে এগুলো দেখাশোনা করে আল্লাহ মালুম। প্রায় দুই ঘণ্টা পরে আমরা ‘দমনার সাদুয়াক ভাসমান বাজারে (Damnoen Saduak Floating Market)’এসে উপস্থিত হলাম।
এই বার আমরা একটু ভাসমান বাজার সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি

১৮৬৬ সালে ‘চকরি রাজবংশের’ আমালে ‘রাজা ৪র্থ রামা’ সামরিক বাহিনীকে এই অঞ্চলে একটি খাল খনন করার নির্দেশ দেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ‘পায়াসরিসুরিওয়াং’ এর নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী এবং সেইসাথে ‘রাতচাবুড়ী’, ‘সামুতসাকারং’ ও ‘সামুতসংক্রাম’ প্রদেশের লোকজন এই খালটি খনন করে। খালটি মূলতঃ ‘থা চিন’ ও ‘মই কলং’ নদীকে সংযুক্ত করে। ১৮৬৮ সালে এই খনন কাজ শেষ হলে জনগণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এই খালের নামই ‘দমনার সাদুয়াক’ আর খালের নামেই এই ‘ভাসমান বাজার’টি পরিচিত। প্রধানতঃ নৌ পথে যোগাযোগ ও পণ্য পরিবহণের উদ্দেশ্য এই খালটি খনন করা হলেও বর্তমানে এই অঞ্চলের কৃষি কাজে সেচের উৎসও এই খাল। মূল খালের সাথে আরও ২০০ টি ছোট ছোট খাল খনন করা হয়েছে। এই খালের অন্তঃজাল ঘিরেই এই অঞ্চলের জীবন-যাত্রা নির্ভরশীল, বেশীর ভাল লোকজনই এই খালগুলোর দুই তীরে বসবাস করে। এই খালগুলি দিয়েই তাদের কৃষি পণ্য আশেপাশের প্রদেশ ও ব্যাংককে বাজারজাত করে। আরও জানতে দেখতে পারেন (১) (২)।
গাড়ী থেকে নামার পরে আমাদের গাইড প্রথমে একঘণ্টা সময় দিল ‘ভাসমান বাজারে’ নিজেদের মত ঘুরতে এর পরে আমাদেরকে খালে নৌভ্রমণ করাবে। এই বাজারে ঘুরাঘুরি করার জন্য বৈঠা বাওয়া ছোট ছোট অনেক নৌকা দেখলাম। এই রকম একটা ছোট নাও ভাড়া করে আমরা চড়ে বসলাম। খাল রঙ-বেরঙের পর্যটক, আর নৌকায় গিজ-গিজ করছে, দুইপাশে অনেক দোকানের সারি এছাড়া নৌকাতেও অনেক সওদা-পাতি বিক্রি হচ্ছে। দুই পাশের দোকান গুলোর প্রধান পণ্য হল হস্তজাতশিল্প ও স্যুভিনিয়র আর ভাসমান নাও গুলোতে মূলতঃ বিভিন্ন ধরনের খাবার বিক্রি হচ্ছে। ‘ভাসমান বাজার’ সম্পর্কে আমার মানসপটে সেই ছোট ছোট নৌকা আর তাতে বিভিন্ন ধরণের স্থানীয় কৃষি পণ্য বিক্রি হচ্ছে আর স্থানীয় লোকজন তা কিনছে এই দৃশ্যের কোন মিল পাই না। চারপাশে বেশী মাত্রার পর্যটন বানিজ্য চোখ পড়ে। পাশের এক ভাসমান নৌকা থেকে আমরা পাকা আম কিনে খেতে থাকি। সাধারণ একটা বাজারে যেমন বিভিন্ন অলিগলি থাকে এখানেও ছোট বড় খাল দিয়ে ঐ রকম অলি গলি দেখতে পাই। আমারা ধীরে ধীরে বাজারের সব অলিগলি ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকি। ব্যাপারটা বেশ মজার নৌকা নিয়েই বিভিন্ন দোকানে থামা যায় আর নৌকা থেকেই কেনা-কাটা করা যায়। আমারা ধীরে সুস্থে বাজার ভ্রমণ শেষ করি।

আগেই বলেছিলাম এই এলাকার জীবন-যাত্রা এই ‘কলং’ বা খাল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এই বিষয় গুলো দেখতে আমরা এবার বড় নৌকায় উঠি। আমাদের যেমন বড় বড় রাস্তা এথেকে বিভিন্ন ছোট ছোট রাস্তার সংযোগ থাকে এখানে দেখি উল্টোটা। বড় বড় বেশ কয়েকটা খাল আর এ থেকে ছোট ছোট সংযোগ খাল রয়েছে। বড় খাল গুলোর দুই পাশে সুন্দর সুন্দর বাংলো ধরণের বাড়ী। বাড়ীতে গাড়ীর বদলে সুন্দর নকশা করা থাই নৌকা বাঁধা। আর এরা মনে হয় ফুল খুবই ভালোবাসে, মোটামুটি সব বাড়ীতেই কম বেশী ফুলের গাছ। কিছু কিছু বাড়ী দেখতে এতও নান্দনিক যে বাড়ীর বারান্দা থেকে চারদিকে ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে। ছোট খালে ঢুকে দেখাগেলো খালের পাড় ঘিড়ে বিভন্ন ফলের চাষ হচ্ছে।
একটা বিষয় দেখে খুব অবাক লাগলো যে নারকেলের বাগানে ৫ ফিটের মত গাছে নারকেল/ডাব ধরে আছে যে হাত দিয়েই গাছ থেকে পাড়া যাবে, এরা মনে হয় বিশেষ জাতের নারকেলের চাষ করে। রাজা ৪র্থ রামা খাল খনন করে দিয়েছিলেন সহজ পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য কিন্তু আধুনিক থাইল্যান্ড এখন এই খালের উপরে নির্ভর করে সুন্দর কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। দামনার সাদুয়াক এখন এই অঞ্চলের খুবই গুরুত্বপূর্ণ কৃষি উৎপাদন এলাকা। আমরা প্রায় ঘণ্টা খানেক এগুলো দেখতে দেখতে খাল ভ্রমণ করি। আমরা দামনার সাদুয়াক ভ্রমণের সুন্দর অভিজ্ঞতা নিয়ে পরবর্তী গন্তব্যের জন্যে গাড়ীতে উঠি।
ভাসমান বাজারে’র ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকটাই মিশ্র, ছবিতে দেখে যেমণ কল্পনা করেছিলাম তার সাথে কমই মিল পেয়েছি। আমার কাছে অতিমাত্রার পর্যটক নির্ভর ও বানিজ্যিক মনে হয়েছে। আশা করেছিলাম কোন নদী বা খালে ছিম ছাম কোন হাট বা বাজার কিন্তু দেখলাম পর্যটকের ভীড়ে আর নৌকার ভীড়ে গিজ গিজ করা এক বাজার। যেখানে স্যুভিনিয়রের দোকান-পাটই বেশী। তবে খাল ভিত্তিক এদের আধুনিক জীবন-যাত্রা আমার কাছে অভিনব লেগেছে সেই সাথে অত্যাধুনিক কৃষি ব্যবস্থাও যা আসলেই সুন্দর ও কার্যকর।
=====================================================================
ছবিঃ মানস চোখ
ক্যমেরাঃ ক্যানন ১১০০ ডি
লেন্সঃ ১৮-৫৫ মি মি
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০১৫ রাত ১২:১৬