(প্রিয় পাঠক/পাঠিকা, এর আগে যে গল্পটি আমি পোস্ট করেছি সেটি লেখার সময়েই আমার মাথায় আসে, আমি তো অনেকের অনেক যৌনবাস্তবতা ও যৌনফ্যান্টাসির কাহিনী জানি। সেগুলির সাথে লেখকসুলভ একটু কল্পনার নুড়ি পাথর মিলিয়ে দিলেই তো গল্পের ইমারত গড়ে উঠতে পারে। সুতরাং শুরু করলাম যৌনমন কিংবা অলিগলি-অন্ধকার!!! সিরিজের গল্পগুলি লেখা। আমি এর অব্যবহিত আগের গল্পটিকেও এই সিরিজের অধীন বলেই মনে করি। সুতরাং সেটির লিংকও এখানে দিয়ে দিলাম। আইবুড়ো কাল এবং দীর্ঘশ্বাস সে হিসাবে আজকের গল্পটি এই সিরিজের ২য় গল্প।
এই সিরিজের অধীনে যে গল্পগুলি আসবে সবই আমাদের যৌনতা নিয়ে। বিভিন্ন কোণ থেকে আমি যৌনতাকে দেখার চেষ্টা করেছি। পরোক্ষে মনোস্তাত্বিক বিশ্লেষণের চেষ্টাও ছিল। বরং বিশ্লেষণ না বলে বিশ্লেষণসহায়ক ইঙ্গিত বলতেই আমি স্বস্তি বোধ করব। কোনো কোনো গল্প থেকে আপনি সচেতনতার বীজ সংগ্রহ করতে পারবেন। কিন্তু যারা রসময় গুপ্তের কাহিনী পড়তে চান তারা নিঃসন্দেহে হতাশ হবেন। যৌনতার রগরগে বর্ণনা নেই। যতটুকু এসেছে তা কাহিনীর প্রয়োজনে। প্রায় প্রতিটি গল্পই বাস্তবতার নিরিখে লেখা। চলেন তবে শুরু করা যাক) :-
--------------------------------------------------------------------
মাসুদ মার্কেটে ঢুকেই ইতস্তত বোধ করতে থাকে। কেমন একটা অস্বস্তি। কোনো দিকে, কারও দিকে সরাসরি তাকাতে পারে না। মনেহয় সবাই তাকে চেনে, সবাই তার উদ্দেশ্য বুঝে ফেলেছে। সে মুখ থেকে একটা কথা বের করা মাত্রই সবাই দুয়ো দিতে শুরু করবে। হাসতে শুরু করবে। তাকে নিয়ে মজা মারবে সবাই। সুতরাং এবংবিধ নানা চিন্তায় সে ঘামতে শুরু করে।
এক ঘন্টার উপরে হয়েছে মাসুদ একটি ম্যানিকিন ডল কেনার জন্য এসেছে, কিন্তু কোন দোকানেই সে ঢুকতে পারছে না। দ্বিধা তাকে কুণ্ঠিত করে রেখেছে। কেবলি মনে হচ্ছে তার মনের কথা সবাই টের পেয়ে গেছে। কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণ। মরিয়া হয়ে সে মনে মনে আওড়ে নিল কিভাবে দোকানদারের সাথে কথা বলবে, যাতে কেউ সুদূর-সন্দেহও করতে না পারে।
কোন রকম বোকামি করা চলবে না। বলতে হবে তার পোশাকের দোকান আছে। এ পর্যন্ত ভেবেই মাসুদ থমকে গেল। দোকানদার যদি তার কাছে দোকানের কার্ড চায়, তাহলে? তার তো কোন কার্ড নাই। থাকার কথাও নয়। কেননা তার তো কোন দোকানই নাই, ছিলও না কোন কালে। কিন্তু দোকানদারকে কার্ড না দিতে পারলে তো মুশকিল। একজন ব্যবসায়ী, যে মার্কেটে এসেছে তার দোকানের জন্য পণ্য কিনতে তার পকেটে অবশ্যই নিজের দোকানের কার্ড থাকবে। এটা পরিচিতির জন্য, প্রচারের জন্য, প্রসারের জন্য অপরিহার্য একটি বিষয়। ব্যবসায়ীরা এ ব্যাপারে খুবই সচেতন। এটা তাদের প্রেস্টিজ ইস্যুও বটে। সুযোগ পেলেই তারা সবাইকে কার্ড ধরিয়ে দেয়। যেন সবাইকে বলতে চায় দেখেন, আমারে বানে-ভাসা কেউ মনে করলে ভুল করবেন। আমার স্থায়ী ঠিকানা আছে, স্থিরতা আছে। আমি একজন সম্মানিত নাগরিক। অতএব আমার অনেক অধিকারও আছে।
সুতরাং একজন পোশাক দোকানদারের কাছে কার্ড থাকবে না, এটা সন্দেহজনক। কিন্তু তার কি ভুল হতে পারে না? ভুলে কার্ড সাথে নিতে স্মরণ নাই, এটাও তো হতে পারে, তাই না? মানুষ তো কত কিছুই ভুলে যায়। এটা তো সামান্য একটা কার্ড।
- এহ হে সরি ভাই। খুবি সরি। কার্ডতো সাথে নাই। কর্মচারিগুলারে সব ছাটাই না করলে আর চলবে না। কতদিন কইছি, আমি যখনি কোথাও যাব, মনেকরে সাথে কার্ড দিয়া দিবি। নাহ একটাবার যদি মনে করে। ভাই সামনে তো আরও কিনতে হবে। পরিচয় যখন হলো , আপনার থেকেই কিনব ইনশা-আল্লাহ। এর পরের বার কার্ড দিয়ে যাব। এখন আপনার একটা কার্ড দিয়ে দেন।
মনে মনে মাসুদ একবার রিহার্সাল দিয়ে নেয়। আচ্ছা এমন ও তো হতে পারে তার নতুন দোকান। এখন পর্যন্ত উদ্বোধনই হয় নি। তাই কার্ড করাও হয় নি। হ্যাঁ এটা অবশ্যই যুক্তিসংগত। কিন্তু চোরের মনে পুলিশ পুলিশ। আর মাসুদের মতো ভীতু হলে তো কথাই নাই। সুতরাং তার খুঁতখুঁতানি শেষ হয় না। অস্বস্তিও দূর হয় না। আরও বেশি করে ঘামতে থাকে।
আরেকটা কাজ করলে কেমন হয়, কোন একটা দোকান থেকে যদি সেই দোকানের কার্ড নিয়ে আসে? কিন্তু পরক্ষণেই চিন্তাটা সে বাতিল করে। কারণ সেই দোকানদার যদি এই দোকানদারের পূর্ব-পরিচিত হয়? বলা তো যায় না, হতেই পারে।
অতএব, অবশেষে সে না কিনেই ফিরে আসে।
লোকটার বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে। এতটা কাল সে নারী সংসর্গ করে নি। করে নি মানে সে অবিবাহিত, করে নি মানে সে কোন সাধু পুরুষ নয় যে সাধুতার জন্য করে নি; সে অতি সাধারণ মানুষ, করে নি মানে তার সুযোগ হয়ে ওঠে নি। জীবনের এতটা পথ চলতে গিয়ে কোনো মেয়ের সাথে সহজ-স্বাভাবিক কোনো প্রকার লেনাদেনার সুযোগ সে পায় নি। একটু অবাক লাগলেও ঘটনা সত্যি। পড়েছে সে বালক বিদ্যালয়ে। দূর থেকেই বালিকাদেরকে দেখে এসেছে সব সময়ে। কিছুটা দূরেই ছিল বালিকা বিদ্যালয়। বালিকাদের বিদ্যালয় শুরু হত ১০টায় আর তাদেরটা শুরু হত ১১টায়। সুতরাং বিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় মিলত না, কিন্তু মাঝেমাঝেই দেখা যেত তাদের এবং ওদের একত্রে ছুটে হয়ে গেছে। তখন বালিকাদের পিছে পিছে ফিরে আসতেও রোমাঞ্চ হত। বালিকাদের দুয়েকটা কথার টুকরা, খিলখিলে হাসির ছিটেফোটা, তাদের মধ্যকার পারস্পরিক খুনসুড়ির কিছু নুড়ি তাকে আপ্লুত করে রাখত। যেন অসহনীয় গরমে অপ্রত্যাশিত বৃষ্টির ছাঁট এসে তাকে জানালা পথে ভিজিয়ে দিত। সেই সামান্য সিক্ততাই তাকে স্বাপ্নিক করে তুলত। আহারে কী যে সুখের সময় ছিল সেই দিনগুলোতে!
হতাশা ছিল। ব্যর্থতা ছিল। কান্না ছিল। সব ছাপিয়ে ছিল খুশি হওয়ার এক অসামান্য ক্ষমতা। কত সামান্যতেই ঐ বয়সে তারা এক আসমান সমান খুশি হতে পারত। রাস্তার পাশে অযত্নে অবহেলায় বেড়ে ওঠা গাছ থেকে জাম, লোহাগাড়া, কিংবা টাকটুক খেয়ে নীল জিভের সেই অহংকার সে কি কেউ কোনোদিন কেড়ে নিতে পারবে তার কাছ থেকে?
সে সময়েই এসেছিল তার জীবনের শ্রেষ্ঠতম সেই দিনটা। সেই দিনের সমান একটা দিন, কিংবা তুলনা করার মতো একটা দিন জীবনে আর এল না। একত্রেই ছুটি হয়ে গিয়েছিল বালক ও বালিকাদের। রাস্তার পাশের একটি জাম গাছের তলায় কয়েকটি মেয়ে জড়ো হয়ে জাম পারার চেষ্টা করছিল। কিন্তু তারা নাগাল পাচ্ছিল না। কয়েকটি ছেলে দূরে দাঁড়িয়ে মেয়েদের ব্যর্থতায় হো-হো করছিল। সে এগিয়ে গিয়ে গাছে চড়বার আগে নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, দাঁড়াও তোমরা। এই সামান্য কথাটিও সে মেয়েদের চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে পারে নি।
আসলে ঘরে তার মা ছাড়া আর কোনো মেয়ে বা মহিলাকে সে পায় নি। বাড়িতে যুবতী মেয়ে বলতে কেউ ছিলই না। চাচীরা, দাদীরা সব প্রৌঢ়া এবং বৃদ্ধা। চাচাতবোনদের সব বিয়ে হয়ে গিয়েছিল বহু বহু আগে। আর তারা আসতও কালেভদ্রে। ফলে মেয়েদের সাথে তার সহজ যোগাযোগ হওয়ার সুযোগ থেকে সে ছিল বঞ্চিত। মেয়েরা তার কাছে তাই যেন অন্য লোকের প্রাণী। অ-তি দূ-রে-র ---- ব-হু দূ-রে-র ---- সে-ই সু-দূ-রে-র কোনো এক মায়া। কোনো এক কুহক। তাদের দেখে রোমাঞ্চ হয়, কত রকম ভাবনা হয়, আবেগের উথাল-পাথাল ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে লক্ষ-কোটি স্বপ্নের প্রজাপতি ডানা মেলে উড়তে থাকে, উড়তেই থাকে এবং আরো কত কি….. কিন্তু তাদের দিকে সরাসরি তাকাবার, তাদের সাথে সহজ-স্বাভাবিক দুইটা কথা বলার সাহস আর হয় না।
মেয়েদেরকে দাঁড়াতে বলে সে তর-তর করে গাছে উঠে জাম পারতে লাগল। হো-হো করে হাস্যরত বীরপুরুষের দল জাম টোকাতে এলে সে স্বভাববিরুদ্ধ স্বরে গর্জন করে উঠেছিল, খবরদার, একটা জামও ধরবি না। এবং মেয়েরাও তার গর্জনের পালে হাওয়া দিলে বীরপুরুষের দল লেজ গুটিয়েছিল। গাছ থেকে নামার পর মেয়েরা তাকে জাম দিতে চাইলে সে কিছুতেই নিতে চায় নি। কারণ সে তো পেরেই খেতে পারে। কিন্তু মেয়েদের আন্তরিক পীড়াপীড়িতে সে আর না করতে পারে নি। সেদিন মেয়েদের সেই কৃতজ্ঞ দৃষ্টি সে কি ইহজীবনে কোনোদিন ভুলতে পারবে? সেদিন তাকে আর মেয়েদের পেছন-পেছন যেতে হয় নি, পাশে-পাশেই অনেক দূর পর্যন্ত যেতে পেরেছিল।
তারপর তো কলেজ। তার ক্লাসে ছিল মাত্র চারটা মেয়ে। লাজুক সে তাদের সাথে কোনোদিন কথা বলতে পারে নি।
গরিব ঘরের ছেলে সে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দায় পা রাখার মতো সুযোগ তার ছিল না। চলে এসেছিল ঢাকায়। তারপর তো শুধু সংগ্রামের ইতিহাস, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ইতিহাস, দুপায়ে কোনোভাবে দাঁড়িয়ে থাকার ইতিহাস। কখনো সস্তা হোটেলের ওয়েটার, ফুটপাথের অস্থায়ী দোকানদার, কখনো বাসের হেল্পার, শেষে এক মুদি দোকানের সেলসম্যান। এভাবেই চলে গিয়েছিল সংগ্রামের প্রথম পাঁচটি বছর। তারপর একটি কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধির সাথে ভাল সম্পর্কের সুবাদে সেই কোম্পানিতে পেয়েছিল বিক্রয় প্রতিনিধির চাকরি। শুরুতে যে এলাকার দায়িত্ব ছিল তার, আজও সেই এলাকার দায়িত্বেই আছে। সাথে আরও বাড়তি এলাকা যোগ হয়েছে। সব দোকানদারের সাথেই তার ভাল সম্পর্ক। এতটাই ভাল সম্পর্ক যে মাঝেমাঝেই তাকে দুপুরে হোটেলে খেতে হয় না। দোকানদারদের সাথে তাকে তাদের বাসায় যেতে হয়। কোনো কোনো দোকানে এখন সে নিয়মিত যেতেও পারে না। ফোনে ফোনেই কাজ সেরে নেয়। অথচ প্রথম ছয়মাসে সে একবারও টার্গেট পূর্ণ করতে পারে নি। বসের কত গালি, কটু কথা শুনতে হয়েছে। কতবার যে চাকরি ছেড়ে দিতে চেয়েছে তার ইয়ত্তা নাই। শুধু সেই বন্ধু বিক্রয় প্রতিনিধির জন্য সে চাকরি ছাড়তে পারে নি।
ছয় মাসে তার পরিচিতি বেড়েছে, দোকানদারদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে, আর ধীরে ধীরে বেড়েছে অর্ডার কাটার পরিমাণ। দোকানদাররা তার সারল্য পছন্দ করে। এমনও দেখা গেছে, কোনো দোকানদার তার কাছে দুষ্টুমি করে কিছু খেতে চেয়েছে অথচ তার কাছে তখন টাকা ছিল না, সে বেতন পেয়ে ঠিক ঐ দোকানদারের জন্য সেই খাবার কিনে নিয়ে গেছে। বলেছে, ভাই, ঐ দিন আমার কাছে টাকা ছিল না। বহুত শরম পাইছি। আর দোকানদার তার সরলতায় মুগ্ধ হয়েছে। আর মুগ্ধ দোকানদাররা মাঝেমাঝেই ফোন করেঃ ভাই, মাল তো শ্যাষ। কবে আইবেন ? তাড়াতাড়ি আইসেন। আরেকটা কোম্পানি আইছিল। তাগো অর্ডার দেই নাই।
এভাবেই একই কোম্পানিতে কেটে গেছে আরও পাঁচটি বছর। কোম্পানি তাকে দিয়ে ঐ এলাকায় একচেটিয়া ব্যবসা করলেও তার বেতন খুব বেশি বাড়ে নি, বাড়ে নি পদমর্যাদাও। এ নিয়ে তার কোনো আফসোসও নেই, চাহিদাও নেই। সে একা মানুষ। কোনো পিছুটান নেই। মা-বাবা নেই, ভাই-বোনও নেই। বেতন যা পেত তা দিয়ে সে, তার মতে রাজার হালেই চলতে পারত। তার সেরকম কোনো স্বপ্নও ছিল না। অনেক রাত করে বাসায় ফিরে তাড়াতাড়ি রান্না করে, খেয়েদেয়ে ঘুম; পরদিন আবার সকালে উঠে তাড়াতাড়ি রান্না, গোসল তারপর খেয়েদেয়ে প্রথমে অফিস তারপর অর্ডার সংগ্রহে গমন। এই ছিল তার রুটিন। শুধু শুক্রবার সাপ্তাহিক বন্ধের দিনে একটু সমস্যা হত। কাপড়চোপড় ধোয়ার পরে হাতে থাকত অফুরন্ত সময়। তখন একাএকা লাগত। মাঝেমাঝে মনে হত কেউ একজন থাকলে মন্দ হত না। স্মৃতির পর্দায় ভেসে উঠত কৃতজ্ঞ কয়েকটি কিশোরীর মুখ।
পাঁচ বছর পর সেই বন্ধু বিক্রয় প্রতিনিধি, যে তখন অন্য এক কোম্পানিতে জেলা ব্যবস্থাপক, আবার তাকে খবর দিল।
- ভাই, আপনি আমার কোম্পানিতে জয়েন করেন। আপনারে আমি থানার হেড হিসাবে নিতাছি। যা বেতন পান তার দ্বিগুণ ধরতাছি। আর অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও আগের চাইতে বেশি পাইবেন।
গত ১০ বছর সে থানাপ্রধান হিসাবে সেই কোম্পানিতেই আছে। নির্ঝঞ্ঝাট জীবন। নিস্তরঙ্গ। একভাবে চলে যাচ্ছে। মা মারা গেছেন ঢাকায় ওঠার ২য় বছরেই। বাবাকে তো সে দেখেই নি। খুব ছোট বেলাতেই তিনি মারা গিয়েছিলেন। আত্মীয়-স্বজন বলতে, – আছে কেউ কেউ। কিন্তু সে যায় না বাড়িতে। সামান্য জমিজমা জ্ঞাতিরাই খাচ্ছে। প্রথম কোম্পানিতে ইস্তফা দেওয়ার পর-পরই সে বাড়িতে গিয়েছিল। বেশ কয়েক বছর পরে। ভাঙ্গা ঘরদোর রাত কাটানোর মতো ছিল না। দুদিন থেকেছিল এক চাচার ঘরে। অনেক সংকোচের পর চাচীর কাছে বলেছিল বিয়ের কথা। কিন্তু তারা বিষয়টার তেমন গুরুত্ব দিলেন না। সেও ঢাকায় এসে নতুন কোম্পানিতে জয়েন করল, নতুন দায়িত্বে ব্যস্ততার পরিমাণ বেড়ে গেল। সুতরাং আর বাড়িও যাওয়া হয় নি, বিয়ের কথা ওভাবে ভাবারও সুযোগ পায় নি। বিয়ের জন্য তাগিদ দেয়ারও তো কেউ আসলে নাই। বিয়ের প্রয়োজনও ততটা সে অনুভব করে কিনা বোঝা যায় না। খুবই অন্তর্মুখী চরিত্রের মানুষ। কারও সাথে এ নিয়ে সে আলাপও করে না। ঈদ-কোরবানিতেও তার বাড়িতে যেতে ইচ্ছা হয় না। কে আছে যে যাবে? তাছাড়া ঈদের সময় যাতায়াতে যে হেপো পোয়াতে হয়, তার চেয়ে ঈদের কয়দিন টানা ঘুম দেওয়া অনেক ভাল।
সহজ সরল জীবন তার। কোনো নেশা নাই। বিলাসিতা বলতে একটাই, এই কোম্পানিতে যোগ দেয়ার পর একা একটি ফ্লাটে থাকে। ২ রুমের ফ্লাট। ব্যালকনি আছে। ব্যালকনিতে মাঝেমাঝে চেয়ার টেনে বসে। কিছুটা সময় সেখানে কাটাতে ভালই লাগে। গত ১০ বছর একই ফ্লাটে কাটিয়ে দিল। এমন পুরুষের অনেক খারাপ অভ্যাস থাকার কথা। একা থাকে। রুমে মাঝেমাঝেই বিশেষ নারীদের আগমন ঘটার কথা। কিন্তু তার শরীরের চাহিদাও সম্ভবত কম। নয়ত নারীর নেশা নাই কেন? অবশ্য তার ঘেন্না লাগে খুব। হাজার পুরুষের চুমুতে পিষ্ট ঐ সব ঠোঁটে সে কিছুতেই ঠোঁট ছোঁয়াতে পারবে না। নারীকে হয়ত তার, জীবনের অপরিহার্য উপাদান মনেহয় না। আসলেই সে ব্যাতিক্রম। মেলানো যায় না এ পৃথিবীর কারও সাথে।
কিন্তু এই আপাত যোগী পুরুষ হঠাৎ করেই ভোগী হয়ে উঠলেন। নারীবিবর্জিত আর তার থাকা হল না। ৪০ পেরিয়ে প্রথম প্রেমের স্বাদ তিনি পেলেন। তুমুল প্রেম! দুকুল ভাসিয়ে নেওয়া প্রেম। এমন প্রেমকেই লোকে অন্ধ প্রেম বলে। এই বয়সের এমন প্রেমের কথা কাউকে বলাও যায় না। আর বলবেনই বা কাকে। তার তো বন্ধু-বান্ধব নেই বললেই চলে।
কিন্তু সে এই ৪০ পেরিয়ে এখন বদলে যাচ্ছে। আশেপাশের সবাইও টের পাচ্ছে সে বদলে যাচ্ছে। তার পোশাক-আশাক, চলন-বলন সবকিছুতেই পরিবর্তনের ছাপ। এখন আর রাত করে বাসায় ফেরে না। বিকাল হলেই সে অস্থির হয়ে ওঠে বাসায় ফেরার জন্য। সন্ধ্যার পর তো সে আউলাঝাউলা হয়ে যায় বাসায় ফিরতে না পারলে। সেই যে-রাতে সে পৃথিবীর সুন্দরীতম মেয়েটিকে, পুতুল যার নাম, গোপনে বাসায় এনে তুলল তার পরদিন থেকেই তার এই অবস্থা।
পুতুল নিখুঁত একটি মেয়ে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যৌনাবেদনময়ী মেয়েটির শরীরের মাপের যে অনুপাত, তার শরীর যেন তারই আদর্শ নমুনা। কালো কুচকুচে তার গায়ের রঙ। যেন কালো গোলাপের হাজারো পাপড়িতে ঢেকে দেয়া তার শরীর। খুঁত শুধু একটাই পুতুল কথা বলতে পারে না। বোবা। এ নিয়ে পুরুষটির কোনো আফসোস নাই। তার ধারণা যে কোনো সাধারণ রমণীর চেয়ে পুতুলের অনুভূতি বেশি প্রখর।
কোনোদিন ফিরতে দেরি হলে পুতুল কোনো অভিযোগ করে না। কিন্তু সে টের পায় পুতুলের তীব্র অভিমান। পুতুলের অভিমানী মুখটা আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়ে সে তার মান ভাঙায়।
তার জীবন এখন কানায় কানায় সুখ দিয়ে ভরা। কোথাও ঘাটতি নাই। নিঃসংগতার চোখ রাঙ্গানি নাই। শুধু রোমান্স আর রোমান্স। প্রতি রাতে পুতুলের শরীর দেখাটা এখন তার একমাত্র নেশা। পুতুল মুখে কিছু বলে না। কিন্তু তার মনেহয়, সে কিছুটা শরমজনিত প্রতিরোধ গড়তে চায়। কিন্তু সে তা মানবে কেন। সে ধীরে ধীরে পুতুলের যাবতীয় বস্ত্রবাধন খুলে ফেলে। কামিজ! কাঁচুলি! সালোয়ার! তারপর অপলক তাকিয়ে থাকে পাহাড়চুড়োয়, নাভিকুসুম ছাড়িয়ে প্রজাপতির উড়তে ইচ্ছুক ডানার কাঁপনে। এক সময় অস্থির হয়ে ওঠে। দুঠোঁটের ব্যবহার পাগলামির পর্যায়ে পৌঁছে যায়। নারী-শরীরের প্রতিটি ইঞ্চি তার চুমুতে চুমুতে সিক্ত হয়ে ওঠে। সে পুতুলের জাগরণ টের পায়। পুতুলও সাড়া দিতে শুরু করে পাগলের মতো। তারপর দুজনের পাগলামি চলতেই থাকে ক্লান্তির আগ পর্যন্ত।
ইদানিং সে অত্যধিক কামুক হয়ে উঠেছে। বহু বছরের বঞ্চনা যেন একবারেই উসুল করার আক্রোশ তার মধ্যে ভর করেছে। মাঝেমাঝে ভয় হয় তার, পুতুল সহ্য করতে পারে তো? ভেঙে পড়বে না তো? পারে নিশ্চয়ই। নয়ত বিরক্ত হয় না কেন? বরং তার পাগলামি পুতুল উপভোগই করে। সব সময়ই সে হাস্যমুখী। এত ভাল কেন মেয়েটা? এত ধৈর্য! ওর স্তনের উপর হাত না রেখে ঘুমালে ইদানিং যেন ঘুমই আসতে চায় না। কিন্তু পুতুল কিছু বলে না। শুধু মুচকি হাসে।
- আরে তুমি হাসতাছ? হাসো! যত খুশি হাসো। আমার প্রাণ তো এখন তোমার মধ্যে। তোমার বুকের ভিতরে একটা মায়ার কৌটা আছে, বুঝলা? ঐখানে জমা রাখছি।
পুতুল সব শোনে আর হাসে। শুধুই হাসে।
চল্লিশ পরবর্তী প্রেমে স্থিরতা থাকার কথা। গভীরতা বেশি কিন্তু উথাল-পাথাল আকুলতা, আবেগের ছেলেমানুষি ছটফটানি কম থাকার কথা। অথচ সে যেন কোনো টিনএইজড বালক। সব আবেগ, অনুভূতি, ছটফটানি যেন সেই অস্থির বয়সের মতো।
সে আবারও হাত রাখে পুতুলের ঠোঁটে, বুকে, নাভিতে ক্রমশ নিচে ……
ক্রমশ নিচে নামতে নামতে সে ক্রমশ উঠতে থাকে। টের পায় পুতুলও উঠছে আবার এবং আবার এবং আবার……
পরের সপ্তাহে মাসুদ আবার মার্কেটে গেল। এবার তার সাথে তার নিজের দোকানের কার্ড আছে। কাল্পনিক দোকান। নতুন একটি মার্কেটের নাম দিয়েছে ঠিকানায়, যে মার্কেটের সব দোকান এখনও বরাদ্দ হয় নি। এরকম একটি অবরাদ্দকৃত দোকানের নাম্বার দিয়েছে কার্ডে। সুতরাং এবার আর কোনো ভয় নাই। আত্মবিশ্বাসের সাথে দোকানে ঢুকবে। কষে দরদাম করবে। তারপর কিনবে। মোটেই ঠকা যাবে না। প্লানের কোথাও কোনো ছিদ্র নাই। বেহুলার বাসর ঘরের চেয়েও সুরক্ষিত। সুতরাং সে একটি দোকানে ঢুকে পড়ল। পছন্দ করে একটি ফুল সাইজ ম্যানিকিন ডল কিনে ফেলল। ডলের বক্সটা নিয়ে বাইরে বের হয়ে হাঁপ ছেড়ে যেন বাঁচল। না কোনো দর কষাকষি করতে হয় নি। পকেট থেকে কার্ডও বের করতে হয় নি। দোকানদার যে দাম চেয়েছিল বিনাবাক্য ব্যয়ে, দরদর করে ঘামতে ঘামতে সে তাই বের করে দিয়েছিল।
দোকানদার তাকে কিছু জিজ্ঞেসই করে নি। সুতরাং কার্ডের প্রশ্নই ওঠে না। অবশ্য তার নিজেরও কার্ডের কথা মনে ছিল না। মনে থাকলে পকেট থেকে বের করে নিশ্চয়ই সে কতগুলি কার্ড দিয়ে আসত।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০১৩ বিকাল ৫:০৬