বিমান বন্দরে বড় ভাই, বড় ভাইয়ের ছোট শালা আর শালার বন্ধুরা সবাই স্বাগত জানায় খন্দকার আনিসুল ইসলাম আনিসকে। বড় বড় লাগেজ-ব্যাগ নিয়ে মাইক্রোবাস যখন ঢাকা ছেড়ে মফস্বলের দিকে চলে তখন আনিসের হাল্কা ঘুম পায়। বড় ভাইয়ের নানান প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে আনিস আধো ঘুমে আধো জাগরণে গড়িয়ে পড়ে। নয় বছর, আহ! নয় বছর যেন ধুম করে চলে গেল আনিসের জীবন থেকে। আনিস তখন মায়ের কথা ভাবে। কেমন আছে মা, দেখতে কেমন হয়েছে! মায়ের শেষ চিঠিটা আনিস কতবার পড়েছে হিসেব নেই। চিঠির প্রতিটি শব্দ-প্রতিটি লাইন মুখস্ত হয়ে গেছে -
বাবা আনিস,
আমার অন্তরের অন্ত:স্থল হইতে দোয়া ও ভালবাসা নিও। অদ্য নয় সন হইতে চলিল তুমি বিদেশ যাপন করিতেছ। আশা করিতেছি খোদার ফজলে কুশলে আছ। তোমার পাঠানো টাকা, চিঠি, তেল-সাবান, জায়নামাজ-তজবী, টেপ রেকর্ডার পাইতেছি নিয়মিত। তোমার পাঠানো টাকায় আল্লার রহমতে তোমার দুই বোনের বিবাহ দিয়াছি। তাহারা সুখে সংসার করিতেছে। বড় মিয়াদের সহিত আমারও দিনকাল ভালো কাটিতেছে। তবুও বুকটা জ্বলিয়া পুড়িয়া যায়। তোমাকে বিবাহ করাইয়া- এই সংসার গুছাইয়া দিয়া পরকালে যাইবার বন্দোবস্ত করিতে চাই। মুন্সী বাড়ির মেজ ছেলে হায়দার দুই বছর অন্তর: বাড়ী আসে। তাহার মুখে শুনিলাম - তুমি এই বছর বাড়ী আসিতে পার। ইহা শুনিয়া আমার আর আনন্দের সীমা নাই। বড় ভাইজানও তাড়া দিতেছেন। সিলভিয়া এইবার ডিগ্রি পরীক্ষা দিবে। ভাইজানরা আর অপেক্ষা করিতে রাজী না। অতি শীঘ্রই বাড়ী আস। তোমার পথ চাহিয়া রইলাম। ইতি -
তোমার দুঃখীনি মা, আয়েশা খাতুন।
আনিস মনে মনে ভাবে - মাকে আর দুঃখ দিবে না। বড় মামার মেয়ে সিলভিয়া বেগমকে বিয়ে করে সংসারী হবে। নয় বছরে সিলভিয়াও নিশ্চয় অনেক বদলে গেছে। আনিসের বুকটা এবার ধুকধুক করে। মনের ভেতর - মাথার ভেতর একটা নাম কেবল ঘুরপাক খায় - সিলভিয়া সিলভিয়া সিলভিয়া। মাইক্রো বাসের ক্যাসেট প্লেয়ারে হিন্দি গান বাজছে - হাম তুমারি হ্যায় তুমারি সনম হ্যয়...ম্যায়নে তুমসে প্যায়ার হে...। গানের কথাগুলো মুছে গিয়ে সুরের সাথে সিলভিয়া নামটি মিলে যায় আর বাতাসে ভেসে ভেসে বেড়ায়।
গাড়ী ছুটছে খাল-বিল পেরিয়ে। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে। মানুষ হাট থেকে ঘরে ফিরছে। রাস্তার পাশের চায়ের দোকানগুলোয় মিটিমিটি সাঁঝবাতি জ্বলছে।
দুই.
মাঝরাতে বাড়ী ফিরে পাড়া প্রতিবেশীর সাক্ষাত, সালাম আদাব শেষে ঘুমাতে ঘুমাতে অনেক রাত হয়ে যায়। তবুও সকালে আজানের শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে আনিস অভ্যাস মতো মসজিদে নামাজ পড়তে যায়। জামায়াতে নামাজ শেষে গ্রামের মুরুবি্বদের সাথে দেখা হয় - মোলাকাত হয়। এত বড় গ্রামে ফজরের নামাজে মাত্র পনের-বিশজন মুসল্লি দেখে আনিস অবাক হয়। মুসল্লিদের সবাই প্রায় বৃদ্ধ। কিশোর-যুবক কিংবা আনিসের বয়সী কেউ নেই। অথচ সৌদি আরবে জোয়ান মানুষদের ধাক্কায় বৃদ্ধরা সামনে জায়গাই পেতো না। এরকম আরো নানান ভাবনা বুকে নিয়ে আনিস হেঁটে চলে রাণীরদিঘির বাম পাশ দিয়ে। সকালের শীতল বাতাস তার লম্বা পাঞ্জাবী-মাথার পাগড়ি উড়িয়ে নিতে চায়। পঞ্চশীলা গ্রামে চলতে চলতে আরো অনেকের সাথে দেখা হয় - আলাপ হয়।
পরের দিনগুলোয় তেরো-চৌদ্দ পদের মাছ-তরকারী, পিঠা পায়েশ খেয়ে আনিস হাঁফিয়ে উঠে। বড় খালা-মেজ খালা-ছোট খালা-বড় মামা-ছোট মামা-দুই বোনের শ্বশুরবাড়ি-বড় ভাবীর বাবার বাড়ী - সব জায়গায় ঘুরে, দাওয়াত খেয়ে - উপহার দিয়ে পনের বিশ দিন কেটে যায়। কেবল সিলভিয়া বেগমের দেখা মিলে না। স্বভাবসুলভ লজ্জায় আনিসও ঐ বাড়ীর দিকে পা বাড়ায় না।
শ্রাবণ মাস শেষ হলেও বৃষ্টি থামেনি। প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা ঝমঝম বৃষ্টি। ঘরে শুয়ে গান শোনা আর ঘুমানো ছাড়া কিছু করার নেই। একদিন টিনের চালে ঝমঝম শব্দের মাঝে হঠাৎ দরজার পর্দার আড়ালেও যেন রিমঝিম শব্দ হয়।
-আছেন কেমন, কি করেন?
এ শব্দ যেন পুরো বৃষ্টির শব্দকে ম্লান করে দেয়। ঘরে যেন আরো অনেকগুলো চুড়ি ভেঙে ভেঙে যায়। রিমঝিম - রুমঝুম - রিনিঝিনি। এরকম আরো অনেক শব্দ। খাট থেকে নেমে দাড়িয়ে আনিস কি বলবে ভেবে পায় না।
"আনিস, তোমার ঘরে সিলভিয়া গেল" - পাশের রুম থেকে বড় ভাবীর আওয়াজ।
কলাপাতা রঙের সালোয়ার কামিজে হাল্কা লিকলিকে শরীর। বেনী করা চুল। কপালে সবুজ টিপ। লিপিস্টিক নেই। সিলভিয়া! সৌদি জীবনের প্রথম দিকে কোম্পানীর মালিকের বোন সেহারিনাকে দেখে মনে হয়েছিল - এই বুঝি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে। অথচ আজ এই মুহূর্তে আনিসের মনে হয় - সিলভিয়ার কাছে ঐ সেহারিনা কিচ্ছু না। তবে সিলভিয়া মাথায় ঘোমটা দিলে আরো ভালো লাগতো।
- কথার জবাব দেন না কেন? বিদেশে থাইকা কি ভদ্্রতাও ভুইলা গেছেন?
সিলভিয়ার কাটাকাটা কথায় আনিস থতমত খায় - ভাল আছি, আমি ভাল আছি। তুমি কেমন আছ?
- ভাল না থাকলে এই ঝড় বাদলার মধ্যে এইখানে ক্যামনে আসলাম?
আনিস আবারো ধাক্কা খায়। সিলভিয়ার চাতুর্য্যে কিছুটা মুগ্ধও হয়।
- শুনেন, দিন নাই-রাত নাই, সব সময় এই লম্বা জোব্বা পরে থাকেন কেন?
- অসুবিধা কি? আনিস সাহস করে প্রশ্ন করে।
-অসুবিধা আছে। আমার ভালো লাগে না। আরবের জামা আরবে পরবেন, বাংলাদেশে না। বুঝতে পারছেন?
সিলভিয়া আর কথা বাড়ায় না। গটাগট চলে যায়। আনিসের মনটা কেমন উড়ুউড়ু হয়ে উঠে। লম্বা জোব্বা পরার ব্যাপারটা সিলভিয়া পছন্দ করছে না। সংসার শুরু করার আগে তার পছন্দ-অপছন্দ জানতে হবে। মেট্রিক ফেল হলেও -খুব বেশী উঁচু সমাজে না মিশলেও আনিস অন্তত: এতটুকু বুঝতে পারে - সংসার জীবনে পারষ্পরিক মিলমিশটা খুব দরকার।
(অসমাপ্ত)
[link|http://www.somewhereinblog.net/ashimulblog/post/18855|e`
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৬ ভোর ৫:০৫