শ্রদ্ধেয় ড. ইউনূস,
শুভেচ্ছা।
ব্যক্তিগত চিঠিটি পড়লাম।
মনে হলো, আপনাকে কিছু লিখবার আছে। তাই লিখছি। আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত নই। দেশের প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমার তুলনায় যে ম্লেচ্ছস্বরূপ এবং সে কারণেই নিজেকে অসম্ভব গুটিয়ে রেখে দুনিয়ার তাবত জঞ্জাল থেকে পাশ কাটিয়ে চলছি, নিজেকে অনেকটা নাক উঁচু ভেবে বসে আছি- বিষয়টি ঠিক সে রকম নয়। বিষয়টা হলো, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত হবার সুযোগ আমার হয়ে ওঠেনি পেশাগত কারণে। বিএনপি-আওয়ামী লীগসহ সমসত্দ রাজনৈতিক দলগুলোকে আমিও চরম গালিগালাজ করেছি। কিন্তু ভেবেছি এটাও, যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির নেতৃত্ব এই বিএনপি-আওয়ামী লীগ দিচ্ছে, সেই সংস্কৃতির একেকটা অংশ আমরা সবাই। আমাদের সবারই ণে ণে করা আচরণ মিলিয়েই এই সংস্কৃতি। লুটপাট, বিশৃংখলা আমরা চাই না। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির এটাও একটা বড় অংশ। কেন? আমরা তো এসব চাই না, তারপরেও এই সংস্কৃতির দায়ভার আমার? অবশ্যই। কারণ আপনি-আমি গোড়া থেকে সহ্য করেছি। এই সিস্টেমের আওতায় বসে থেকে তাতেই মানিয়ে নিতে চেয়েছি। এরশাদের আমলে লাভের ষোলোকলা খেয়েছি। খালেদার সময়ে মুনাফার সবটুকুই নিয়েছি। হাসিনার সময়ে আরো অনেক বেশি করে চেটেপুটে খেয়েছি। যারা খাইনি তারা নীরব থেকেছি। কাজেই এই রাজনৈতিক সংস্কৃতির দায় আমরা কেউই এড়াতে পারি না। ঠিক তেমন করেই ভবিষ্যতে যা হবে তার দায়ও আমরা কেউ এড়াতে পারবো না।
বাঙালি হিসেবে আপনার নোবেল পাওয়া নিয়ে আমি গর্বিত। কিন্তু আপনার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি না, আপনাকে নিয়ে যে মাতামাতি চলছে তার প্রয়োজন খুব বেশি। কিন্তু এখানেও আমরা আমাদের ষোলোআনা সাংস্কৃতিক পরিচয় বহাল রেখেছি। যে হারে মাতামাতি করছি, তাতেও যে বাসত্দবতার চেয়ে আবেগই বেশি থাকতে পারে তা এখনো মাথায় ঢোকে না। এ তো সেই আবেগই, যেই আবেগে অন্ধ হলে মানুষ চোখ বন্ধ করে সিল মারে। কাজেই আবেগের সংস্কৃতি কাজে তো লাগছে!
আপনাকে ত্রাণকর্তা হিসেবে রাজনীতিতে নামার জন্য কীভাবে বিপুল মানুষ অনুরোধ জানালেন, আমি পরিষ্কারভাবে তা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি। বাংলাদেশের জনসংখ্যার অনুপাতে আপনাকে জানানো সেই অনুরোধওয়ালা মানুষ আসলে কয় জন? কিংবা যদি অন্যভাবে বলি, এই যে জোবরা গ্রাম থেকে উঠে আসা মানুষ আপনি, নোবেল পাবার পর থেকে দেশের রাজনৈতিক ডামাডোলের সময় জুড়ে কয়টি দিন বাংলাদেশের কয়টি প্রত্যনত্দ গ্রামের কতোজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন? প্রয়োজন হলে পাশাপাশি এটিও দেখতে পারেন, কতোদিন দেশের বাইরে কাটিয়েছেন? নাকি আপনি আপনার অসাধারণ শক্তিশালী বিচারবুদ্ধি দিয়ে টের পেয়েছেন, মানুষ আপনাকে রাজনীতিতে চায়? আমার তো মনে হয় না যে, দেশের বিপুল পরিমাণ আধা ন্যাংটো মানুষজন, যাদেরকে পুঁজি করে অনেকে অনেক রকমের ব্যবসা ফেঁদে রাখেন, তারা আপনার মোবাইল কিংবা ফোন নম্বর জানবে। অথবা আপনার কাছে চিঠি লিখার ঠিকানা জানবে। নাকি আপনার কাছে বিপুল মানুষ তারাই যাদের সঙ্গে আপনি সমপ্রতি বেশি সময় কাটিয়েছেন? কাজেই এই খোলা চিঠির শুরুতেই আপনার উচিত ছিলো বিষয়টি পরিষ্কার করা।
রাজনীতির আমূল বদলের কথা বলেছেন। আমাদের সবার মনের কথা। কিন্তু সেই বদলটা কীভাবে? কোনপথে? সেই আমূল বদলটা কে করবে? যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির কথা আপনি বললেন, সেই সংস্কৃতিতে যেহেতু আমরা সবাই বসবাস করি, কাজেই আমি মনে করি না, আপনি আজ যা বলছেন তাতে আপনাকে শতভাগ বিশ্বাস করার কোনো কারণ আছে। আপনাকে নিয়ে আমাদের গর্ব নোবেল পাওয়া হয়তো হতে পারে, কিন্তু প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি বুঝতে শিখিয়েছে, সব আশ্বাসই ফাঁকা বুলি হয়ে যায় একসময়। আর সব রাজনৈতিক পদেেপর পেছনেই কোনো একটি শক্তি থাকে। যে রাজনীতির আমূল বদলের কথা আপনি বলছেন, তা এভাবে যদি নাও বদলে ফেলা হতো, তবু বদলাতো। কারণ কোনো নেতা কিংবা হাতিয়ার নয়, মানুষই ইতিহাস বিনির্মাণ করে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষ নিজেরাই দ্রোহী হয়ে ওঠে। আর আপনার তো অজানা নয়, সেই দ্রোহই মুক্তির পথ করে দেয়। আমাদের আফসোস, স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের দেশে কীভাবে জানি, মানুষের সেই দ্রোহ পুরোপুরি প্রকাশিত হবার আগেই 'উদ্ভূত' পরিস্থিতি বদলে ফেলা হয়েছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। দেশে স্থিতাবস্থা বিরাজ করার সুবিধা অনেক- ব্যবসা করা যায়, টাকা খাটানো যায়, মুনাফা নেয়া যায়। কিন্তু মানুষ দ্রোহী থাকলে মুশকিল। কাজেই এভাবে পরিস্থিতি বদলে ফেলা অনেকের জন্য ভালো হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে একেকটি পরিস্থিতি বদল হয়েছে আর আমরা এক ঝাঁক নতুন নতুন বড়লোকদের পেয়েছি। সবাই হয়েছে আঙুল ফুলে কলাগাছ। কাজেই রাজনীতিতে নামুন কি না নামুন, আপনি ত্রাণকর্তা- এই বাংলা শব্দটি অথবা এ জাতীয় কোনো কিছু আপনার জন্য ভুলে যাওয়াই হবে ভালো। কারণ এসব চিনত্দা আপনাকে মানুষের কাছে নিয়ে যাবে না।
আমার মনে হয় না, আমাদের চিঠির ওপর ভিত্তি করে আপনি রাজনীতি করার সিদ্ধানত্দ নেবেন। আপনার সিদ্ধানত্দ অনেক আগেই নেয়া হয়ে গেছে। এখন শুধুমাত্র ওয়ার্ম আপ চলছে। তারপরেও আপনাকে বেশ কিছু বিষয় জানানোর ছিলো, লিখলাম। আপনার জন্য শুভকামনা। এই একটা বিষয় ছাড়া বাঙালির করার আর কিছু নেই। সবই অন্যেরা করে দেয়, চাপিয়ে দেয়। আমরা তাই এই একটি কাজই করতে পারি। আপনার েেত্র তাই করলাম।
ধন্যবাদসহ
শিবলী নোমান
রাজশাহী
12 ফেব্রুয়ারি 2007
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০