ত্রিভুজের যেই পোস্ট নিয়ে এত কান্ড, সেখানে একটা মন্তব্য আমি করেছিলাম, সেটারই এক রকম সমপ্রসারণ করছি এখানে। কালপুরুষের পোস্টটা ভাল লেগেছে।
নিজেস্ব পরিমন্ডলে নারী পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক আর ব্যবহার দেখে বড় হয় মানুষ, পরবতর্ী জীবনে এই নিজেস্ব পরিমন্ডল থেকে হাতে কলমে শিখা জিনিসগুলোই মূল্যবোধ হিসেবে কাজ করে।
ছোটবেলা থেকেই আমার বাবা মা দু'জনের মধ্যে দেখেছি সহযোগিতা, পরম নির্ভরতা, ঘনিষ্ট সম্পর্ক, চেতনায় মিল আর সুন্দর একটা পরিবার গড়ে তোলার ব্যপারে দু'জনে যৌথ প্রচেষ্টা, সহযোগিতা। আসলে সুস্থ সামাজিক আর পারিবারিক পরিবেশ গড়ে তুলতে নারী পুরুষকে কতর্ৃত্ব খাটানোর প্রতিযোগিতার উধের্্ব উঠতে হবে।
মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান আমি। বাবা মা দু'জনেই চাকুরিজীবি, জন্মের পর থেকেই তাই দেখে আসছি। বাবা ঢাবির অধ্যাপনা। মা একটা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষকতা করেন। আর ফুল টাইম মাতৃত্ব।
মা, উনিশ বছর বয়সে বিবাহিতা, বিয়ের এক বছরের মাথায় এক পুত্রের মা। মা আমার সুপার উইম্যান। সত্যিকার অর্থে। একই সাথে পড়াশোনা করেছেন, ক্যারিয়ারে যেই ডিগ্রী দরকার করে ফেলেছেন দ্বিধাহীন ভাবে, সন্তান বড় করেছেন এবং বিশ বছর থেকেই শিক্ষকতা করছেন। সব এক সাথে।
এখন মাকে দেখি আর মুগ্ধ হই। একজন মানুষ এত জীবনী শক্তি পায় কোথথেকে? সকাল নয়টা থেকে পাঁচটা স্কুল (হুম, অস্ট্রেলিয়াতে টিচিঙের জন্য প্রয়োজনীয় স্কীল আপগ্রেইডিঙের করে ফেলেছেন ঝটপট), তারপরেও বাসায় আনা স্কুলের কাজ, এরপরে রান্না বান্না, পরের দিন সবার লাঞ্চ রেডি করা, ঘর গোছানো, সামাজিকতা, বাগানের কাজ সব করে যান ঝট পট, ক্লান্তিহীনভাবে। বাবা মাকে ডাকে 'ম্যানেজার এন্ড এমপ্লয়ী'। একই সাথে দু'টোই। একটা কোম্পানীর ম্যানেজার কাজ করা ছাড়াই হাইলি পেইড হয় শুধু চিন্তা ধার দেয়ার জন্য। মা আমার বাথরুমের কল নষ্ট হলেও সেটা ঠিক করার ম্যানেজারি করে, আর ক্রমাগত শারিরীক শ্রম তো দেয়ই ক্লান্তিহীন ভাবে। একটা কিচ্ছু এদিক সেদিক হয় না। যে কোন দিন, যখনই মেহমান আসুক মাকে কখনও অপ্রস্তুত হতে দেখিনি। ঝটপট কিছু একটা রেঁধে ফেলেন। হঠাৎ এক সকালে উঠে লাউ পাতার ভর্তা জাউ খেতে ইচ্ছা করলেও তার উপায় হয়ে যায়। একবার বাবার সাথে অসহযোগিতা আন্দোলন করায় তো আমাদের অবস্থা সকরুণ। বাবা সকাল বিকাল রাত আমাদের ডাল আর আলু ভর্তা খাইয়ে প্রায় মেরে ফেলে আর কি... সামাজিকতাতেও বাবা গোল্লা পাবে।
বাবা মাকে সহযোগিতার সব রকম চেষ্টা করে। কিন্তু কর্মক্ষমতায় সত্যিই পেরে উঠে না। রান্নার সময় কিচেন হ্যান্ড হয়ে সব সময় পিঁয়াজ কাটা থেকে অন্যান্য কাজে সাহায্য করে, কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হয় না, দ্যা রিয়েল ম্যানেজার ইজ মা।
বাবা মা দু'জনেই কাজ করলে সন্তানদের প্রতি মনযোগ দিতে পারেন কম, এটা সত্য হত যদি মায়ের এত অফুরন্ত জীবনী শক্তি না থাকত। বাসায় কতগুলো বাধা নিয়ম আছে, যার জন্য হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের বাঁধন ঢিলা হয় না, একাকিত্ব কুঁড়ে খায় না যেমন:
1. বাসায় থাকলে, বিশেষত ডিনার আর উইকেন্ডে একসাথে খাওয়া দাওয়া, খাবার টেবিলে (অন্যথা হলে অবস্থা বারোটা বেজে যায়)।
2. সপ্তাহে একদিন, এক ঘন্টার জন্য নিয়ম বেঁধে বাসার সবার 'মিটিঙে' বসা
3. সুযোগেই এদিক সেদিক বেড়িয়ে পড়া, একসাথে ঘুরতে যাওয়া।
এর প্রতিটাই নিয়ম করে হয় সেটা মা-ই দেখেন। এ গ্রেইট ম্যানেজার শি ইজ!
মাকে এত উদ্যোমে সব করতে দেখে আমার কিন্তু ভয় লাগে, মনে হয়, উহু আমি কখনও এত গুলো ফুল টাইম কাজ এক সাথে করতে পারব না, পারব না! এজন্যই দাবী জানাই, কতগুলো। একজন নারী হিসেবে, যেই নারীর হয়ে সমাজ সব সময় সিদ্ধান্ত নিয়ে দেয় আর নারীর সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় যে কোন কাজে:
1. লেট মি ডিসাইট হোয়াট টু ডু! নারী অবলা এই চিন্তা আউট করেন, আমি চাইলে আমি বাইরে কাজ করব, চাইলে চাকরি ছেড়ে দিব। এই স্বাধীনতাটুকু চাই!!!
2. আমার বায়োলজিক্যাল নিডকে সামনে রাখবে এমন একটা সুস্থ সুন্দর কর্মক্ষেত্র। এখানেই মায়ের স্কুলে এক গর্ভবতী মহিলা খুব অসুস্থ থাকায় প্রায়েই ছুটি নিচ্ছেন বলে তাকে স্কুল বেতনহীন ছুটি নিতে বাধ্য করছেন। যেই পরিবারে নারীই প্রধান আয় করেন, সেই পরিবারের নারীর প্রতি কত বড় অবিচার হবে এই অবস্থায় কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য চাপ দেয়া! বাংলাদেশে, আমার ছোট বোন হওয়ার সময় ছুটি না পাওয়ায় মা চাকরিই ছেড়ে দিয়েছিল মনে আছে।
3. চাকরীক্ষেত্রে যোগ্যতা অনুযায়ী সম্মান! যারা পাশ্চাত্যের মোহে ছুটেন, তাদের বলি, পাশ্চাত্যে চাকরী ক্ষেত্রে 'গ্লাস সিলিং' বলে একটা টার্ম প্রচলিত আছে। একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ের পরে মেয়েরা আর উপরে উঠতে পারে না। একটা অদৃশ্য কাচের সিলিং তাদের গতিরোধ করে। পাশেই পুুরুষ সহকমর্ীরা তরতরিয়ে উপরে উঠে যায়, মুক্ত আকাশে। এমনকি, অনেক চাকরিতে একই কাজ করার পরেও নারীদের বেতন পুরুষদের চেয়ে কম। হুম, এটা সত্যি।
4. যৌথ পরিবারের প্রত্যাবর্তন!
ইংল্যান্ডে চাকরীর সময় মা নিজের চাকরী ক্ষেত্রের চাইল্ড কেয়ার সেন্টারে আমাদের রাখতেন, তাই অত অযত্ন হয় নি। বাংলাদেশে আমাদের ফুপাত বোন বা খালা সাথে থাকত, এবং আমি মনে করি পরিবারের মানুষের স্নেহ ছায়ায় বড় হওয়ার বিকল্প কিছুই নেই। এখন থেকে লাইন দিয়ে রেখেছি, আমার লাইফ পার্টনারের মা বা আমার মা একজনকে আমার সাথে থাকতেই হবে । আসলে যৌথ পরিবারের উষ্ণতা আমি পাই নি, যেটা থেকে কারও বঞ্চিত থাকা উচিৎ না।
পরিবার সমাজের ক্ষুদ্রতম কিন্তু সবচেয়ে পাওয়ারফুল ইউনিট। এই পরিবারের প্রয়োজনে নারী পুুরুষকে সহযোগিতা করতে হবে পরস্পরের সাথে। পরিবারের প্রয়োজনকে সামনে রেখে ইনডিভিজুয়্যাল নারী পুরুষকে সিদ্ধান্ত নিতে দিন কি করবে!